ডিসেম্বরের গোড়ায় সর্ষে লাগিয়েছিলেন নদিয়ার হবিবপুরের শঙ্কর সাহা। ফেব্রুয়ারির শুরুতে ফুল ফুটতে শুরু করতেই বিপত্তি। ফুলের পাপড়ি শুকিয়ে যাচ্ছে। পোকার উত্পাতও বেড়েছে।
পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথি মহকুমার তেঁতুলমুড়ির নিমাই হোতারও একই অবস্থা। নিজের দু’বিঘা জমিতে বরবটি, সিম, আর বাঁধাকপি লাগিয়েছিলেন। পাতা পচে যাওয়া আর গোড়া পচে যাওয়া থেকে ফসল বাঁচাতে দিন দশেক ধরেই বিভিন্ন কীটনাশক প্রয়োগ করছেন। কিন্তু লাভ কিছু হয়নি। প্রতিবেশী ভগবতী হোতারও দেড় বিঘা জমির আলুর ক্ষতি হয়েছে অল্প বিস্তর। কৃষি বিজ্ঞানীদের দাবি, এবারের শীতে মরসুমি ফসল মার খেয়েছে আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনায়। গাছের স্বাভাবিক সালোক-সংশ্লেষ প্রক্রিয়াই ব্যাহত হয়েছে। ফলনেও তার প্রভাব পড়েছে। তাই সবজি চাষিদের তাঁদের পরামর্শ, ফলনের ক্ষতি কমাতে স্বল্প ব্যবধানে একই জাতের ফসল চাষ করলে ফলনের এই বিপর্যয় কমানো যাবে।
বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী কৌশিক ব্রহ্মচারী বলেন, ‘‘এগুলি সবই বিকিরণজনিত ক্ষয়ক্ষতি। তাপমাত্রার সঙ্গে আপেক্ষিক আর্দ্রতাও বাড়ছে। ফলে গোড়া পচা, ফল পচা, পাতা পচার ঘটনা ঘটছে। একই কারণে সর্ষের ফুল ফোটার সময় জাপ পোকার উত্পাত বেড়েছে।’ বিজ্ঞানীদের বক্তব্য, এমনিতেই এখন দিন ও রাতের তাপমাত্রার ফারাক অনেক বেশি। তার উপর দিনের কড়া রোদে ঝলসে যাচ্ছে ফসল। গুণগত মানও কমছে। কৌশিকবাবুর বলেন, ‘‘এই বিপর্যয়গুলি সাময়িক। যিনি সর্ষে লাগিয়েছেন তিনি যদি কিছুটা জমি ছেড়ে রাখেন, আর ১৫দিনের ব্যবধানে দ্বিতীয় দফায় ফের একই জাতের সবজি ফাঁকা জায়গায় লাগান তাহলে ফসল ফলিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসতে হয় না। এছাড়া বিভিন্ন ওষুধ আছেই।’’
গোটা বিশ্বজুড়েই আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনায় বিভ্রান্ত সাধারণ কৃষকেরা। কোথাও তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে। কোথাও বা অতি বৃষ্টির ফলে ফসল নষ্ট হচ্ছে। এ রাজ্যেও, বিশেষ করে দক্ষিণবঙ্গে এবার শীতের মরসুমে জাঁকিয়ে শীত না পড়া এবং শীতের শুরুতে বা সরস্বতী পুজোর আগে অন্যবারের মতো বৃষ্টি না হওয়ায় ফসলের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়েছে। তাপমাত্রা বাড়ায় ফসলের বৃদ্ধি যেমন মার খেয়েছে, তেমনি আগাছাও বেড়েছে। কৃষি-বিশেষজ্ঞদের মতে, আগাছা বেড়ে যাওয়ায় পোকার আক্রমণও বেড়েছে। একবার বৃষ্টি হলে একটু ঠান্ডা পড়ত। তাতে পোকার আক্রমণ যেমন কমত, তেমনি ধানের ফলন ভাল হত। তবে এই আবহাওয়ায় লাভ বলতে একমাত্র আমের মুকুলের বৃদ্ধি দ্রুত হবে বলে জানান কৃষিবিজ্ঞানীরা।
নদিয়ার চাষি শঙ্করবাবু বলেন, “বেশ কয়েক বছর ধরেই বর্ষা পিছিয়ে যাচ্ছে। শীতও তেমন পড়ছে না। দিনের বেলা আচমকা তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। ফসলের বৃদ্ধি কমে যাচ্ছে। এমনটা কয়েক বছর ধরে লক্ষ্য করছি। বিধানচন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। ওখানকার বিজ্ঞানীরা আসবেন বলেছেন। হুগলির চাষি প্রকাশ সামন্ত অবশ্য জানাচ্ছেন, কৃষিবিজ্ঞানীদের সঙ্গে আলোচনা করে ওই পদ্ধতিতে চাষ করে ফল পেয়েছেন তিনি। অন্য চাষিদেরও জানাচ্ছেন।
কাঁথির ভগবতী হোতা অবশ্য জানাচ্ছেন, আগের বার ১৫ দিনের ব্যবধানে দু’বার সর্ষে চাষ করেছিলেন তিনি। প্রথমবার ফলন তেমন না হলেও পরের বারের ফলনে ঘাটতি পুষিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এ বছর বাধাকপি চাষ করার সময়ে বুঝতে পারেননি আগের বারের মতো করেই চাষ করবেন কিনা। প্রকাশ, ভগবতী বা শঙ্করেরা হয়তো যোগাযোগ করতে পেরেছেন কৃষি বিজ্ঞানীদের সঙ্গে। কিন্তু অধিকাংশ প্রান্তিক কৃষকই তাঁদের পরামর্শ জানতে পারছেন না বলে জানাচ্ছে কৃষিবিশ্ববিদ্যালয়। তাই চাষের ক্ষতি হলেও কার্যত অসহায় তারা। তাই তাঁদের কথা মাথায় রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে ১৮০০৩৪৫৫২৩৫ এই টোল ফ্রি নম্বরটি। এখানে নিখরচায় ফোন করে ওই সব চাষিরা কৃষিবিজ্ঞানীদের পরামর্শ নিতে পারবেন বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে জানানো হয়েছে। |