নদী যার বালি তার।
এই যুক্তিতেই বালির রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের রাজস্ব আধিকারিকদের কাছ থেকে চলে গেল সেচ দফতরে। গত মাসের শেষে বাণিজ্য ও শিল্প দফতরের একটি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বালি তোলার অনুমতি, তার রাজস্ব নির্ধারণ করা এবং রাজস্ব আদায় করা, এই সবক’টি কাজের অধিকারই এখন সেচ দফতরের। নদী থেকে বালি তোলার অনুমতি দেওয়ার ক্ষমতাও জেলা শাসকের হাত থেকে সেচ দফতরের কার্যনির্বাহী ইঞ্জিনিয়ারদের দেওয়া হয়েছে। মোরাম, পাথর প্রভৃতি অন্যান্য ক্ষুদ্র খনিজ থেকে রাজস্ব আদায়ের ভার অবশ্য থাকছে ভূমি দফতরেরই।
সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছে। এ মাস থেকেই সেচ দফতর রাজস্ব সংগ্রহ শুরু করবে। সব ইঞ্জিনিয়ারকে নিয়ে এ বিষয়ে আমরা বৈঠক ডাকছি।” তিনি জানান, দীর্ঘদিন ধরেই সেচ দফতর বালি মাফিয়াদের রুখে দেওয়ার চেষ্টা করছিল। কিন্তু আইনি জটিলতার কারণে তা সম্ভব হচ্ছিল না। “সম্প্রতি রাজ্যের বাণিজ্য দফতর থেকে আমরা প্রয়োজনীয় অনুমতি পেয়েছি। এ বার থেকে বালি তোলা সংক্রান্ত অনুমতি ও তার রাজস্ব আদায় আমাদের দফতরই করবে।” রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রাও দ্বিগুণ করেছে, জানান সেচমন্ত্রী।
কিন্তু কাজটা করবে কে? সেচ দফতরে বালির রাজস্ব আদায় করার লোক কোথায়?
নতুন দায়িত্বের কথা জানার পর তাই মাথায় দিয়ে বসেছেন সেচ দফতরের ইঞ্জিনিয়াররা। তাঁদের একজনের কথায়, “আমরা খাল কাটতে পারি, সেতু বানাতে পারি, চাষের জন্য জলও দিতে পারি। কিন্তু রাজস্ব আদায় করব কী ভাবে? এবার থেকে কি কারিগরি ছেড়ে নদীর ধারে ঘুরে বেড়াব কারা বালি চুরি করছে দেখতে?” আর ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের এক আধিকারিকের কথায়, “আমাদের দফতরে গ্রাম পঞ্চায়েত পর্যন্ত রাজস্ব আধিকারিকের পদ রয়েছে। তাতেও বালি চুরি আটকাতে পারিনি। সেচ কী করে কী করবে, বুঝতে পারছি না।”
পরিকাঠামোর প্রশ্নটি যে বড় হয়ে উঠবে, তা ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতর এবং সেচ দফতরের পরিকাঠামো পাশাপাশি দেখলেই বোঝা যায়। জেলা, মহকুমা ও ব্লক, প্রতিটি স্তরে ভূমি ও ভূমি সংস্কার আধিকারিক রয়েছেন। তার সঙ্গে প্রতিটি অফিসেই একাধিক রাজস্ব আধিকারিকেরও পদ রয়েছে। এমনকি প্রতিটি গ্রাম পঞ্চায়েত অফিসেও রয়েছে একটি করে রাজস্ব আধিকারিকের পদ। তার তুলনায় সেচ দফতরের পরিকাঠামো অনেক দুর্বল। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় এক জন সুপারিন্টেন্ডিং ইঞ্জিনিয়ার (ওয়েস্টার্ন সার্কেল-২) রয়েছেন। রাজস্ব বিভাগ রয়েছে মেদিনীপুর শহরে মূল অফিসে। বাকি কয়েকটি জায়গায় ক্যাম্প অফিস রয়েছে। যেখানে প্রায় ৬০ জন কর্মী থাকার কথা, সাকুল্যে ১২ জনের মতো রয়েছেন। তাঁরা জলকর সংগ্রহ বা সেচ দফতরের জমি কাউকে লিজে দেওয়া হলে তার রাজস্ব আদায় করেন। বালির রাজস্ব আদায়ের অভিজ্ঞতা নেই তাঁদের। সেচমন্ত্রী অবশ্য জানান, রাজস্ব আদায়ের পরিকাঠামো তৈরি করতে পরিকল্পনা নিয়েছে তাঁর দফতর (বক্স দেখুন)।
বালি থেকেই আসে ক্ষুদ্র খনিজের রাজস্বের সিংহভাগ। ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতর সূত্রের খবর, ২০১২-১৩ সালে পশ্চিম মেদিনীপুরে ক্ষুদ্র খনিজ থেকে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ২০ কোটি টাকারও বেশি, যার অধিকাংশটাই বালি থেকে। চলতি অর্থবর্ষে অক্টোবর পর্যন্ত আদায় হয়েছে ১৪ কোটি টাকারও বেশি। স্বভাবতই, এই বিপুল রাজস্ব তুলতে যথেষ্ট সংখ্যায় প্রশিক্ষিত কর্মী প্রয়োজন।
অন্য দিকে, বালি চুরি বন্ধ করা গেলে রাজস্ব বাড়বে কয়েকগুণ। নিয়মিত তল্লাশি চালিয়ে বেআইনি বালির গাড়ি ধরে জরিমানা আদায় করেন ভূমি আধিকারিকরা। কিন্তু সব সময়ে পুলিশকে পাওয়া যায় না বলে অনেক গাড়ি ধরা যায় না। এমনকী অতিরিক্ত জেলাশাসকের নির্দেশেও তল্লাশির সময় নিয়মিত পুলিশ মেলে না। সেচ দফতরের ইঞ্জিনিয়ারদের কথায় কি পুলিশ যাবে? বালি চুরি রোখা যাবে?
বালি চুরিই যে সরকারি কর্তাদের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ, তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। পশ্চিম মেদিনীপুরে সুবর্ণরেখা, কাঁসাই, শিলাবতী ও কেটিয়ার খাল থেকেই বেশি বালি তোলা হয়। তারও সিংহভাগ আসে কাঁসাই থেকে যে নদী ঝাড়গ্রাম, মেদিনীপুর সদর, কেশপুর, দাসপুর হয়ে পূর্ব মেদিনীপুরে গিয়েছে। কাঁসাই নদীতে আবার সব থেকে বেশি বালি তোলা হয় ধেড়ুয়া থেকে ডেবরা পর্যন্ত। যার দু’পাশে ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের ছ’টি ব্লক অফিস, দু’টি মহকুমা অফিস এবং জেলা অফিস রয়েছে। এর বাইরেও একাধিক গ্রাম পঞ্চায়েতে এক জন করে রাজস্ব আধিকারিক রয়েছেন। তবু বালি চুরি বন্ধ করা যায়নি। এমনকী মেদিনীপুর শহরের পালবাড়ি এলাকার পাশ দিয়ে বয়ে-যাওয়া কাঁসাই নদীতে যন্ত্রে বালি তোলায় নদীগর্ভে এমন গর্ত হয়েছে যে, অনেকের মৃত্যুও ঘটেছে বালি চাপা পড়ে। এলাকার কাউন্সিলর সৌমেন খানের কথায়, “বারবার প্রতিবাদ জানিয়েও অবৈধ বালি তোলা বন্ধ করায় প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপ লক্ষ করা যায়নি।”
এই পরিস্থিতিতে সেচ দফতর কী ভাবে বালি চুরি বন্ধ করবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। কারণ, সুবর্ণরেখা গোপীবল্লভপুর থেকে নয়াগ্রাম-কেশিয়াড়ি-দাঁতন হয়ে গিয়েছে। শীলাবতি গড়বেতা থেকে চন্দ্রকোনা, ঘাটাল, দাসপুর হয়ে গিয়েছে। এর অনেক ব্লকে সেচের কোনও আধিকারিক নেই। কোথাও বা আছেন কেবল ইঞ্জিনিয়ার, সার্ভেয়ার, করণিক। রাজস্ব আদায় করবে কে, এই মুহূর্তে তার উত্তর মিলছে না।
তাই প্রশ্ন উঠছে, পরিকাঠামো তৈরির আগেই রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা সরানো হল কেন? জেলায় কানাঘুষো, একটি বালি তোলার প্রকল্প নিয়ে দুই দফতরের মধ্যে সংঘাতের জেরেই চটজলদি এই সিদ্ধান্ত। মেদিনীপুর শহরঘেঁষা কাঁসাই নদীর উপর অ্যানিকেত (জল ধরে রাখার জন্য বাঁধ) তৈরির কাজ শুরু হয়েছে কয়েক মাস আগে। কাজটি করছে সেচ দফতর। কাজের বরাত পেয়েছে সরকারি সংস্থা ম্যাকিনটস বার্ন। ওই সংস্থা গত ডিসেম্বর মাসে নিচু জমি ভরাট করার জন্য নদী থেকে বালি তুলেছিল সরকারি অনুমতি ছাড়াই। তাই ওই সংস্থাকে ১ কোটি ৭০ লক্ষ টাকা জরিমানা করে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতর। তা নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছিল দুই দফতরের মধ্যে।
এর ঠিক এক মাস পরে ২১ জানুয়ারি ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের হাত থেকে বালির রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে সেচ দফতরের হাতে তুলে দেওয়া হয়। তাই প্রশ্ন উঠছে, ওই ঘটনারই ফল হিসেবে তড়িঘড়ি ক্ষমতা হস্তান্তর হল কি না। সেচ দফতর সূত্রেও জানা গিয়েছে, বালি রাজস্ব আদা
বালি চুরি রুখতে নেমে পায়ের তলায় মাটি খুঁজে পাবে কি না সেচ দফতর, এখন সেটাই দেখার।
|
বালির দায়িত্বে সেচ দফতর |
কী করতে চায় |
বালি থেকে রাজস্ব ১২৫ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৫০ কোটি করা। |
কী করে করবে |
রাজস্ব আদায়ের উপর নজর রাখতে মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে একটি দল তৈরি হয়েছে।
সেচের যে রাজস্ব অফিসাররা রয়েছেন, এখন তাঁদের কাজ সীমিত। তাঁদের আরও সক্রিয় করা হবে।
বেশ কিছু নতুন ‘রাজস্ব অফিসার’ নিয়োগ করবে সেচ দফতর।
সেচ দফতরের গ্রুপ ডি কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে পাঠানো হবে নানা জেলায়। |
|