রক্ষী ছাড়াই পার্কে চড়ুইভাতিতে মাতলেন বন্দিরা
তাঁরা খুবই ‘বিশ্বস্ত’।
তাই তাঁদের জন্য ছিল না চার দেওয়ালের ঘেরাটোপ। ছিল না নজরদারি আর নিরাপত্তার কড়াকড়ি। খোলা আকাশের নীচে চড়ুইভাতির আনন্দ লুটেপুটে নিলেন মেদিনীপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারের ১৯ জন বন্দি। নিজেরাই চাঁদা দিলেন। হেঁসেলের দায়িত্বেও ছিলেন তাঁরা।
রবিবার মেদিনীপুর শহর থেকে কিছুটা দূরে গোপগড় ইকো-পার্কে বন্দিদের নিয়ে চড়ুইভাতির আয়োজন করেছিলেন সংশোধনাগার কর্তৃপক্ষ। যে ১৯ জন বনভোজনে গিয়েছিলেন, তাঁরা সকলেই সাজাপ্রাপ্ত। কেউ খুন, কেউ ধর্ষণ, কেউ বা বধূ নির্যাতনের দায়ে জেল খাটছেন। পিকনিকে গিয়েছিলেন জেলার স্বপনকুমার রায়, সাব-জেলার মনোজকুমার সিংহ, ডেপুটি জেলার অভিজিৎ বিশ্বাস, ওয়েলফেয়ার অফিসার মহুয়া বাগচি মিত্র-সহ সংশোধনাগারের ৭ জন আধিকারিক এবং কর্মীও। এআইজি (কারা) কল্যাণকুমার প্রামাণিক বলেন, “আগে কোনও সংশোধনাগারে এ ভাবে পিকনিক হয়নি। সব বন্দিদের গাড়ি করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ওঁরাই রান্নাবান্না করেছেন।” মহুয়াদেবীর কথা, “বন্দিদের নিয়ে পিকনিকের মতো একটা উদ্যোগ মেদিনীপুর থেকে শুরু হওয়ায় ভাল লাগছে।”
গোপগড় পার্কে চলছে মেদিনীপুর সংশোধনাগারের বন্দিদের চড়ুইভাতি।
রয়েছেন ওয়েলফেয়ার অফিসার মহুয়া বাগচি মিত্র। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।
কিছু দিন আগে মুক্তিপ্রাপ্ত ঋতুপর্ণা-নাইজেল অভিনীত ‘মুক্তধারা’ ছবিটির বিষয়বস্তুই ছিল জেলবন্দিদের দিয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘বাল্মিকী প্রতিভা’ মঞ্চস্থ করা। বন্দিদের মানসিকতা পরিবর্তনে সেই উদ্যোগটা ছিল জেল কর্তৃপক্ষের। মেদিনীপুরে চড়ুইভাতির ভাবনাটা কিন্তু বন্দিদের মাথাতেই এসেছিল। সংশোধনাগার সূত্রে খবর, অসীম ভট্টাচার্য নামে সাজাপ্রাপ্ত এক বন্দি প্রথম এই প্রস্তাব দেন। লিখিত আবেদনে ওয়েলফেয়ার অফিসারকে জানান, তাঁরা কয়েক জন মিলে পিকনিক করতে চান। এবং সেটা জেলখানার বাইরে। প্রস্তাব পৌঁছয় রাজ্য কারা দফতরে। আবেদন মঞ্জুরও হয়। ১০ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত অসীম এ দিন বলছিলেন, “সত্যি সত্যিই যে জেল চত্বরের বাইরে বেরিয়ে আমরা পিকনিক করতে পারব, কর্তৃপক্ষ সেই অনুমতি দেবেন, ভাবতে পারিনি। আগে প্যারোলে বাড়ি গিয়েছি। কিন্তু সবাই মিলে পিকনিকের আনন্দ, কিছুতেই ভোলার নয়।” যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত নন্দ চট্টোপাধ্যায়েরও বক্তব্য, “অনেকের অনেক স্বপ্ন থাকে। সব সত্যি হয় না। আজ আমাদের একটা স্বপ্ন সত্যি হল।”
এ দিন সকাল সকাল গোপগড় পার্কে চলে এসেছিলেন অসীম ভট্টাচার্য, নন্দ চট্টোপাধ্যায়, স্বপন মাল, গোপাল ভট্টাচার্যরা। মেনুও ছিল জম্পেশ। সকালের জলখাবারে পাঁউরুটি, কলা, ডিমসেদ্ধ, সন্দেশ। মধ্যাহ্নভোজে ভাত, ডাল, আলুপোস্ত, পাঁঠার মাংস, চাটনি, রসগোল্লা। বন্দিরাই রান্না সারেন। কেউ সব্জি কেটে দেন, কারও ভাগে পড়ল কড়াইয়ে ডাল চাপানোর দায়িত্ব। তদারকির দায়িত্বে মহুয়াদেবী। ওয়েলফেয়ার অফিসারকে বলতে শোনা যায়, “ডালে নুনটা ঠিক আছে কি না, দেখে নিও।” পার্কে আসার পথে বন্দিরাই মিষ্টি কিনে আনেন। ১০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত গোপাল ভট্টাচার্য বলেন, “সব আয়োজন আমরা নিজেরাই করেছি। প্রত্যেকে ৩০০ টাকা করে চাঁদা দিয়েছি। তবে জেলের আধিকারিক ও কর্মীদের সহযোগিতা ছাড়া এই আয়োজন সম্ভব হত না।”
জেলবন্দিদের সমাজের মূলস্রোতে ফেরাতে নানা কর্মসূচি নিয়ে থাকেন কর্তৃপক্ষ। অনেকে জেলে থেকে পড়াশোনা করেন। ছবি আঁকা, নাচ-গানের তালিম নেওয়া, এমনকী জেল চত্বরে বন্দিদের উদ্যোগে দুর্গাপুজোও হয়। মেদিনীপুর সংশোধনাগারেও আবাসিকদের একটি সাংস্কৃতিক দল রয়েছে। সেখানে কেউ ছবি আঁকেন, কেউ ছৌ নাচ করেন। জেলের বাইরে বেরিয়ে এঁরা অনুষ্ঠানও করেছেন। তবে, তখন সঙ্গে সশস্ত্র রক্ষী ছিল। নিরাপত্তারক্ষী ছাড়া বাইরে বেরিয়ে এতক্ষণ কাটানো এই প্রথম।
সশস্ত্র রক্ষী ছাড়া বন্দিদের নিয়ে চড়ুইভাতি করার সিদ্ধান্তটা কি ঝুঁকির ছিল না?
মেদিনীপুর সংশোধনাগার কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, যে ১৯ জন পিকনিকে যেতে চেয়ে আবেদন করেছিলেন, তাঁরা বেশ কয়েক বছর ধরে মেদিনীপুরে আছেন। তাঁদের আচার-আচরণ যথেষ্ট ভাল। ফলে, এই বন্দিদের ভরসা করতে জেল-কর্তৃপক্ষের খুব একটা সমস্যা হয়নি। মহুয়াদেবীর কথায়, “আমরা ওঁদের বিশ্বাস করেছিলাম। আবাসিকেরা সেই বিশ্বাসের মর্যাদা রেখেছেন।”


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.