বহু বাধা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গে ছয়টি নূতন বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হইতেছে বলিয়া মুখ্যমন্ত্রী গর্ববোধ করিয়াছেন। উচ্চশিক্ষার প্রসার অতি জরুরি কাজ। রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় যদি প্রকৃতই উচ্চ মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়িয়া উঠে, যদি জেলার ছেলেমেয়েদের কলিকাতা বা ভিন্ রাজ্যের মুখ চাহিয়া না থাকিতে হয়, তাহা গর্ব করিবারই কথা। কিন্তু, মুখ্যমন্ত্রী যতই ‘ইচ্ছা থাকিলেই উপায় হয়’ মন্ত্রে বিশ্বাসী হউন, শুধু ইচ্ছায় উচ্চমানের প্রতিষ্ঠান গড়িয়া তোলা দুষ্কর। সাম্প্রতিক কালে পশ্চিমবঙ্গে যতগুলি বিশ্ববিদ্যালয় গড়িয়া উঠিয়াছে, প্রতিটিই এই কথাটির পক্ষে সাক্ষ্য দিবে। বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করিতে সম্পদ প্রয়োজন। আর্থিক জোর না থাকিলে যেমন পরিকাঠামো গড়িয়া তোলা সম্ভব নহে, তেমনই মানবসম্পদের জোর না থাকিলেও চলিবে না। প্রশ্ন হইল, বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে এই দুই সম্পদ যথেষ্ট আছে কি?
সরকারের যে টাকার জোর নাই, তাহা মুখ্যমন্ত্রী বিলক্ষণ জানিবেন। একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে পঠনপাঠন ও গবেষণার উপযুক্ত করিয়া তুলিতে চাহিলে যে পরিমাণ বিনিয়োগ প্রয়োজন, তাহা জোগাড় করা রাজ্য সরকারের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। কিন্তু, তর্কের খাতিরে ধরিয়া লওয়া যাউক, কোনও জাদুমন্ত্রে টাকার সংস্থান হইল। রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় সত্যই বিশ্বমানের পরিকাঠামোসমৃদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হইল। কিন্তু তাহার পর? শুধু পরিকাঠামো থাকিলেই তো চলিবে না, তাহা ব্যবহার করিবেন কে? সত্যই কি যথেষ্ট সংখ্যক বিশ্বমানের অধ্যাপক পাওয়া যাইবে? প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদাহরণটি এই ক্ষেত্রে দুই ভাবে স্মরণীয়। প্রথমত, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য যে মেন্টর গ্রুপ কাজ করিতেছেন, তাঁহারা সর্বোচ্চ মানের শিক্ষাবিদ। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সত্যই বেশ কয়েক জন উচ্চমানের শিক্ষক আসিয়াছেন, তাহার পিছনে মেন্টর গ্রুপের অবদান অনস্বীকার্য। তবুও, প্রেসিডেন্সির ক্ষেত্রেও উৎকর্ষের সমস্যা ষোলো আনা মিটিয়াছে, এমন দাবি করা কঠিন। রাজ্যের জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় নির্মিত হইলেই দুনিয়া জুড়িয়া কর্মরত বাঙালি ও অন্য শিক্ষকরা ‘মন চল নিজ নিকেতনে’ বলিয়া পড়াইতে আসিবেন কি?
সফল বিশ্ববিদ্যালয় গড়িয়া তুলিতে শিক্ষা-সংগঠনের ক্ষমতার বিকল্প নাই। এমন মানুষ প্রয়োজন, গোটা দুনিয়ার শিক্ষাজগতে যাঁহাদের পরিচিতি ও যোগাযোগ প্রশ্নাতীত। তাঁহারা জানিবেন, কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন শিক্ষক কোন বিষয়ে কাজ করিতেছেন, এবং তাঁহাকে নূতন বিশ্ববিদ্যালয়ে লইয়া আসিতে হইলে কী করা বিধেয়। দুর্ভাগ্যক্রমে, এই রাজ্যে এই গোত্রের সাংগঠনিক ক্ষমতা সুলভ নহে। অন্তত, পশ্চিমবঙ্গে ছয়টি নূতন বিশ্ববিদ্যালয় গড়িয়া তুলিবার পক্ষে যথেষ্ট নহে। যাঁহারা প্রকৃতই সেই ক্ষমতার অধিকারী, তাঁহাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ইতিমধ্যেই প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহিত বিভিন্ন ভাবে যুক্ত। প্রেসিডেন্সি অক্সফোর্ডকে ছাপাইয়া যাইতে পারে কি না, তাহা ভবিষ্যৎ বলিবে, কিন্তু রাজ্যের আর কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই সম্ভাবনার তিলমাত্র নাই। নূতন বিশ্ববিদ্যালয় হইতেই পারে, কিন্তু তাহাতে মধ্যমেধার সাধনার অতিরিক্ত কিছু হইবে না। তাহার জন্য আর নূতন কেন্দ্রের প্রয়োজন কী? রাজ্যের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই সাধনাই তো চলিতেছে। উৎকর্ষের সাধনা জরুরি। তাহার প্রসারও আবশ্যক। সেই দিকে মন দেওয়া সরকারের কর্তব্যও বটে। কিন্তু উৎকর্ষের স্বার্থেই সাধ্যের প্রতি নজর রাখিয়া অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন। নচেৎ হিতে বিপরীত হইবার আশঙ্কা প্রবল। |