বেলা বারোটা থেকে সমানে চেঁচিয়ে চলেছেন সঞ্জু ওবেরয়। একটাই কথা, “হোটেল ওবেরয়ে ডিম-ভাত কুড়ি টাকা, ডিম-ভাত কুড়ি টাকা।”
একটু দূরেই রংবেরঙের জামা নিয়ে বসে গৌতম পোদ্দার। সামনে উবু হয়ে বসে সেই জামার স্তূপ নেড়েচেড়ে, ঘেঁটেঘুঁটে দেখছেন জনা পাঁচেক যুবক।
একটু দূরে ইমিটেশনের গয়না দেখতে ব্যস্ত একদল মহিলা। হাতে হাতে বিকোচ্ছে সস্তা দরের জুতোও।
ছবিটা কার্যত মেলার। তবে জায়গাটা ব্রিগেড ময়দান। রবিবার যেখানে বামফ্রন্টের ডাকা সমাবেশে যোগ দিতে এসেছিলেন কয়েক লক্ষ মানুষ। মাঠে ভিড় করে নেতাদের বক্তৃতা শোনার পাশাপাশি সেখানেই খাওয়াদাওয়া, কেনাকাটাও সারলেন তাঁরা। কেউ কেউ ঘুরে এলেন চিড়িয়াখানা-ভিক্টোরিয়ায়। যা দেখে-শুনে এক পুলিশকর্মীর উক্তি, “শহরে শীত উধাও। পিকনিকের মেজাজটা কিন্তু পুরোদস্তুর।”
পুলিশ সূত্রের খবর, সকাল থেকেই ব্রিগেডে আসতে শুরু করেছিলেন জেলার বাম সমর্থকেরা। বারোটার পর থেকে ঢুকতে শুরু করে কলকাতা ও লাগোয়া জেলার জনতা। তবে এ দিন কেনাকাটা বা ডিম-ভাতের খদ্দের বেশি ছিলেন জেলার মানুষেরাই। ব্রিগেডে পসরা সাজিয়ে বসা বিক্রেতারা বলছেন, দূর-দূরান্ত থেকে আসা মানুষজনই খাওয়াদাওয়া করেন। |
বাড়ি ফেরার সময়ে শহর থেকে বাড়ির লোকেদের জন্য কিনে নিয়ে যান জিনিসপত্র।
বিক্রেতাদের এই কথা যে কতটা সত্যি, তার প্রমাণ দিলেন সঞ্জু ওবেরয়। হেস্টিংস এলাকার বাসিন্দা এই যুবক তিন বন্ধুকে নিয়ে ব্রিগেডে টেবিল পেতে ডিম-ভাত বিক্রি করতে বসেছেন। বললেন, “দুপুর দুটোর মধ্যে শ’পাঁচেক প্লেট বিক্রি হয়েছে।” হাত দশেক দূরে রঞ্জিত সাউয়ের দোকানে অবশ্য তেমন ভিড় নেই। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ডিম-ভাতের দর সেখানে তিরিশ টাকা। এত কেন? রঞ্জিতের উত্তর, “আমার দোকানের ডিমের সাইজ বড়।”
বাজার মন্দ নয় পোশাকবিক্রেতা তাপস দাসেরও। অন্য দিন ধর্মতলায় ফুটপাথে দোকান সাজান। এ দিন এসেছিলেন ব্রিগেডে। বললেন, “জিন্স-চিনোজ যা-ই নেবেন, ১০০ টাকা।” সারা দিনে অন্তত পঞ্চাশটি প্যান্ট বিক্রি করেছেন। বাজার তেমন ভাল ছিল না খিদিরপুরের কিশোর মহম্মদ সাবিরের। তার দোকানে ৭৫ টাকায় জামা মিলছিল। কিন্তু খদ্দের মেলেনি।
শীত উধাও তো কী হয়েছে! ব্রিগেডে এ দিন হরেদরে বিকিয়েছে কমলালেবুও। ছোট মাপের চারটে লেবু দশ টাকা। বড় মাপের চারটে লেবু কুড়ি টাকায় মিলেছে। এমনই এক বিক্রেতার কাছ থেকে লেবু কিনছিলেন হুগলির বাসিন্দা কবিতা বাউড়ি। বললেন, “ঘরে নাতি-নাতনি রয়েছে। ওদের জন্যই নিচ্ছি।” তবে সবাই কবিতাদেবীর মতো নয়। অনেকেই লেবু কিনে মেতেছেন খোশগল্পে। তার ফাঁকে ফাঁকেই টুপটাপ মুখে পুরেছেন লেবু।
ঝুটো গয়না বা জুতোর দোকানেও দিনভর আনাগোনা। সভা শেষের পরে এক তরুণী ঝুঁকে পড়ে হার দেখছিলেন। এক মহিলা চেঁচিয়ে বললেন, “আর কত দেখবি! তাড়াতাড়ি চল। বাস ছেড়ে দেবে।” তড়িঘড়ি দাম মিটিয়ে হার ব্যাগে ভরলেন ওই তরুণী। পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক মহিলা স্বামীকে তখন স্বামীকে বলছেন, “৫০ টাকায় চটিটা ভালই হল।”
এ সবের বাইরে দেদার বিকিয়েছে চিরাচরিত তালপাতার টুপি। ময়দানে রোদ ঠেকাতে টুপি কেনেন সব দলের সমর্থকেরাই। সমাবেশের ফারাকে শুধু বদলায় টুপির রং। এক টুপি-বিক্রেতা শেখ তোয়েব বললেন, “তৃণমূলের সমাবেশ নীল, সবুজ টুপির চাহিদা বেশি। বিজেপিতে কমলা, সিপিএমে লাল।”
তবে ব্রিগেডের ভোজ কিংবা নেতাদের বক্তৃতাএ সবের বাইরেও কেউ কেউ ঘুরে দেখেছেন শহর। যেমন বাঁকুড়ার ফণীভূষণ সরকার। সমাবেশে যোগ দিতে ভোরবেলায় সপরিবার হাজির হয়েছিলেন শহরে। সমাবেশ শুরু হতে দেরি দেখে সটান চলে যান চিড়িয়াখানায়। ঘুরেফিরে বেলা একটার মধ্যে ফের ময়দানে। এ কি সমাবেশের ‘সাইট সিয়িং’?
মুচকি হাসলেন ফণীভূষণ। |