প্রতিভার অভাব নেই। খামতি নেই প্রতিভা তুলে আনার সদিচ্ছাতেও। কিন্তু, একটা পুরোদস্তুর মাঠ না থাকলে কী ভাবে তা সম্ভব?
এই প্রশ্ন শিলিগুড়ি শহরের একাধিক ক্রিকেট প্রশিক্ষণ শিবিরের কর্মকর্তা ও প্রশিক্ষকদের। ক্রিকেট খেলছেন যাঁরা, প্রশ্নটা তাঁদেরও। সমস্যা কতটা প্রকট, তা শহরের সবেচেয়ে নামী অগ্রগামী ক্রিকেট কোচিং সেন্টারের কর্তাদের সঙ্গে কথা বললেই স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ঘটনা হল, তিন দশক প্রশিক্ষণ শিবির চালিয়ে শিলিগুড়ি থেকে ভাল ভাল খেলোয়াড় উপহার দিলেও বড় মাঠ না থাকায় ঠিক ভাবে অনুশীলন করাতে গিয়ে বাধা পাচ্ছে অগ্রগামী ক্রিকেট কোচিং সেন্টার। এত দিন কোনও রকমে কাজ চালিয়ে দিলেও এখন বড় মাঠের অভাবে তাঁদের ক্রমশ পিছিয়ে পড়তে হচ্ছে বলে আক্ষেপ অগ্রগামীর প্রধান কোচ তথা মহকুমা ক্রীড়া পরিষদের ক্রিকেট সচিব জয়ন্ত ভৌমিকের।
শহরের সবচেয়ে বড় ক্রিকেট ক্লাব। অথচ নিজস্ব মাঠ তাদেরও নেই। যেটা আছে, তাতে কোনও রকমে অনুশীলন করানো গেলেও ম্যাচ খেলানো অসম্ভব। তবু তারই মধ্যে নিজেদের প্রচেষ্টায় জয়ন্তবাবুরা গড়ে তুলেছেন ছ’টি টার্ফ উইকেট ও পাঁচটি কংক্রিটের পিচ। মাঠের সমস্ত বিষয় পরিচর্যা করে খুদেরা। তাই ছোট হলেও মাঠটির অবস্থা ভাল। জয়ন্তবাবু বলেন, “সব কিছু নিজে হাতে করলে মাঠের প্রতি মমত্ব বাড়ে। খেলার প্রতি নিষ্ঠাবান হওয়া যায়।” |
মাঠ-সমস্যার কথা মেনে নিয়েছেন অগ্রগামী ক্লাব থেকে উঠে আসা, বর্তমানে ‘টিম ইন্ডিয়া’-র সদস্য ঋদ্ধিমান সাহাও। বতর্মানে জাতীয় দলের সঙ্গে নিউজিল্যান্ড সফররত ঋদ্ধিমান শেষ বার যখন শিলিগুড়ি এসেছিলেন, তখন মেনেছিলেন মাঠ না থাকার সমস্যা স্থানীয় উঠতি ক্রিকেটারদের ভোগাচ্ছে। বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়েও বেড়ে ওঠা এই উইকেট রক্ষকের কথায়, “আমাদের শহরে প্রতিভার অভাব নেই। তবে এটা ঘটনা যে, ভাল মাঠ পেলে আরও কিছু ছেলে জাতীয় স্তরে খেলতে পারে।”
এ কথা মানছেন অন্য ক্রিকেট প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের কর্তারাও। আসলে শুধু অগ্রগামী নয়, শিলিগুড়ির কোনও ক্রিকেট প্রশিক্ষণ শিবিরেরই নিজস্ব বড় মাঠ নেই। ক্লাবের সামনে এক চিলতে জমি বা কোনও ফাঁকায় অস্থায়ী ভাবে চলে প্রশিক্ষণ। কোচেদের আক্ষেপ, এ ভাবে একটা স্তরের বাইরে ক্রিকেট শেখা সম্ভব নয়। বিশেষ করে, গোটা মাঠ না পেলে গ্রাউন্ড ফিল্ডিং অনুশীলন করা যায় না। আর ভাল ফিল্ডার না হলে যে কোনও খেলোয়াড় আধুনিক ক্রিকেটে অচল, তা কে না জানে! শিলিগুড়ি সুপার ডিভিশনের বাঘা যতীন অ্যাথলেটিক ক্লাবের ক্রিকেট প্রশিক্ষণ শিবিরের দায়িত্বে থাকা বিবেক সরকার বলেন, “শহরে কোনও ক্লাবেরই মাঠ নেই। মাঠের অভাবে সম্পূর্ণ খেলোয়াড় তৈরি করা যাচ্ছে না। নিজেদের মাঠ না থাকায় ভাল টার্ফ উইকেট তৈরি করা যায় না। কারণ, তাতে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পিচ নষ্ট হয়ে যায়।”
একই মত শিলিগুড়ি মহকুমা রেফারি অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য ও ক্রিকেট আম্পায়ার দেবাশিস গুহর। তাঁর কথায়, “এমনকী, ক্রীড়া পরিষদেরও পূর্ণাঙ্গ মাঠ নেই। ফলে কোনও ক্লাব ইচ্ছে করলেও ম্যাচ অনুশীলন করাতে পারে না। ক্রীড়া পরিষদের উচিত তেমন ক্রিকেট মাঠের বন্দোবস্ত করা। না হলে অচিরেই শিলিগুড়ির ক্রিকেট শেষ হয়ে যাবে!” এতটা কড়া ভাবে না বললেও শিলিগুড়ির প্রাক্তন ক্রিকেটার তথা সুপার ডিভিশনের ক্লাব ইয়ং মেন অ্যাসোসিয়েশন, দেশবন্ধু স্পোর্টিং ইউনিয়ন-সহ একাধিক ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত কৃষ্ণেন্দু পাল বলছেন, “গোটা মাঠ না পাওয়ায় ম্যাচ অনুশীলন করানো যায় না। ফলে, আমাদের তাকিয়ে থাকতে হয় লিগ ম্যাচের দিকে। আর বছরে একটা লিগ খেলে ভাল পারফরম্যান্স করা অসম্ভব।”
একাধিক প্রশিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, মাঠের অভাবে বছর দুয়েক আগে শিলিগুড়ির সুপার ডিভিশন ক্রিকেট লিগটাই বন্ধ রাখতে হয়েছিল। আগে কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়ামে ক্রিকেট ও ফুটবলদুই-ই হত। এমনকী, এখানে রঞ্জি ও দেওধর ট্রফির খেলাও হয়েছে। এখন সেখানে শুধুই ফুটবল ম্যাচ হয়। গত দু’তিন বছর হল সুপার ডিভিশন লিগ হচ্ছে মাটিগাড়ার চাঁদমণি মাঠে। এই মাঠটি ম্যাচ করানোর উপযোগী। তবে, সেখানেও পরিকাঠামোগত নানা সমস্যা আছে। প্রথম ডিভিশন লিগের হাল আরও খারাপ। ওই লিগ সাধারণ আয়োজিত হয় তরাই স্কুল মাঠে। কিন্তু, তার জন্য ক্রিকেট-কর্তাদের তাকিয়ে থাকতে হয় স্কুল কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের দিকে।
সব মিলিয়ে ঋদ্ধিমান, দেবব্রত দাসদের শহরে ক্রিকেট-পরিকাঠামোর হাল যথেষ্টই খারাপ। মাঠ-সমস্যার কথা স্বীকার করে শিলিগুড়ি মহকুমা ক্রীড়া পরিষদের সচিব অরূপরতন ঘোষ বলেন, “মাঠের অভাব রয়েছে। তবে মাটিগাড়ায় মাঠকে পূর্ণাঙ্গ ক্রিকেট মাঠ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এর পরিকাঠামো দেখে গিয়েছেন সিএবি কোষাধ্যক্ষ বিশ্বরূপ দে। মাঠটিকে একটু ঠিক করে নিলেই তা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরের হয়ে ওঠার সব রকম সম্ভাবনা রয়েছে।”
আপাতত এটাই আশা শিলিগুড়ির ক্রিকেটের জন্য। |