ময়দানের পূর্ব প্রান্তে পার্ক স্ট্রিটের দিকে শনিবার বিকেলে চোখে পড়ছিল তাঁকে। কাঁধে একটা ব্যাগ। জলপাইগুড়ি থেকে এসেছেন। রাতটা মাঠেই থাকবেন।
কিন্তু ব্রিগেড সমাবেশ তো আজ, রবিবার! এত আগে থেকে? আগন্তুকের জবাব, “মিটিংয়ের আগের দিন রওনা দিলে চিনে ফেলতে পারে! তাই একটু আগে চলে এসেছি।” মাঠের যে দিকে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন ওই বাম সমর্থক, তার ঠিক উল্টো প্রান্তে, রেস কোর্সের দিকে শামিয়ানা খাটিয়ে রাত কাটানোর ব্যবস্থা হয়েছে তাঁদের। সমাবেশের জন্য মাঠ সাজানোর কাজ করতে করতেই দক্ষিণ দিনাজপুর থেকে আগত এক সমর্থকের মন্তব্য, “ভাগ্যিস শীতটা চলে গিয়েছে! রাতে মাঠে শুতে কোনও অসুবিধা হবে না!”
রাজ্যে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরে ২০১২-র রাজ্য সম্মেলন উপলক্ষে প্রথম ব্রিগেড সমাবেশ করেছিল সিপিএম। দু’বছরে গঙ্গা দিয়ে আরও জল গড়িয়েছে। একের পর এক নির্বাচনে বামেদের রক্তক্ষয় অব্যাহত থেকেছে। কিছু পঞ্চায়েত বা পুরসভা জিতলেও সে সব ফের দখল হয়ে গিয়েছে শাসক দলের হাতে! সিপিএমের অল্প কিছু লোক-সহ শরিক দলের নেতা-কর্মীরা শিবির ছেড়ে গিয়েছেন, যোগ দিয়েছেন শাসক দলে। |
আজ যদি বাধা পাই... সেই আশঙ্কায় রাতে মাঠেই আস্তানা বাম সমর্থকদের। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক। |
রাজ্য জুড়ে হোর্ডিং-ফ্লেক্স-ব্যানারে ব্রিগেডের প্রচারে তৃণমূল তো বটেই, বিজেপি-র চেয়েও পিছিয়ে থেকেছে বামেরা। এমন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে এ বার পুরনো কায়দায় ছোট ছোট সভা করে ব্রিগেডের প্রচার চালানোর চেষ্টা করেছেন বামেরা। এক কালে জেলায় যাঁরা ভলভো বাসে চেপে পর্যন্ত দলের কর্মসূচিতে গিয়েছেন, তাঁদের বড়
অংশকেই আজ শিয়ালদহ ও হাওড়া স্টেশনে নামতে দেখা যাবে লোকাল ট্রেন থেকে। এক দিকে যেমন বাস বা গাড়ি বেশি ভাড়া করতে গেলে শাসক দলের হুমকির মুখে পড়তে হচ্ছে, তেমনই এই সাধারণত্বকেই আপাতত সম্পদ হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে বামেরা।
বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু এ দিন বলেছেন, শাসক দলের চোখরাঙানি, বাধা দান সত্ত্বেও ঐতিহাসিক সমাবেশ হবে! তাঁর দাবিকে কটাক্ষ করে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের মন্তব্য, “ঐতিহাসিক সমাবেশ তৃণমূল করে দেখিয়েছে। ভবিষ্যতে ওই রেকর্ড ভাঙলে তৃণমূলই ভাঙতে পারে!” এমন মন্তব্যে দমে না গিয়ে বাম নেতৃত্ব অবশ্য আশা করছেন, কয়েক দিনের মধ্যে তৃণমূল ও বিজেপি-র ব্রিগেড হয়ে যাওয়ায় তাঁদের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে বাড়তি তাগিদ কাজ করবে বলে।
ব্রিগেডের মঞ্চ থেকে লোকসভা ভোটের কিছু প্রার্থী ঘোষণার চেষ্টা অবশ্য শেষ পর্যন্ত সফল হচ্ছে না। সিপিএমের রাজ্য কমিটিতে শনিবার রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর লিখিত নির্দেশিকায় জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, প্রার্থীদের নাম নিয়ে জেলায় জেলায় আলোচনা নিষ্পত্তি করে ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে আলিমুদ্দিনে তালিকা জমা দিতে হবে। তার পরে শরিকদের সঙ্গে কথা বলে তালিকা ঘোষণা করে প্রস্তুতি শুরু করা হবে। তার সঙ্গেই এ দিনের রাজ্য নেতৃত্বের তরফে দলকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, শারীরিক ভাবে সক্ষম, এলাকায় কাজ করতে পারছেন এবং ভাবমূর্তিতে সমস্যা নেই ২০০৯ সালের লোকসভায় জয়ী এই রকম সাংসদকেই এ বারও প্রার্থী করতে হবে। যা নিয়ে আবার প্রশ্ন উঠেছে দলের অন্দরেই।
বর্ধমান-সহ কয়েকটি জেলার নেতারা পাল্টা সওয়াল করেছেন, এ বারের নির্বাচন অনেক কঠিন। সেখানে বাঁধা গতে লড়লে হবে না। কোনও অভিন্ন সূত্র সকলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। প্রসঙ্গত, সিপিএমের বর্তমান সাংসদ সংখ্যা ৯। বাকি আসনগুলিতে গ্রহণযোগ্য এবং পারতপক্ষে কম বয়সের মুখ খুঁজতে বলা হয়েছে আগেই। সংখ্যালঘু ও মহিলা মুখের ভারসাম্য রক্ষার কথাও প্রার্থী বাছাইয়ের রূপরেখায় বলে দেওয়া হয়েছে। রাজ্য কমিটির বৈঠকের ফাঁকে এ দিন বিমানবাবু বলেছেন, “প্রার্থী করার ক্ষেত্রে নীতি-প্রকরণ কী হবে, তা নিয়ে আলোচনা চলছে। বিভিন্ন জেলাকে আরও খতিয়ে দেখে প্রার্থী ঠিক করতে বলা হয়েছে।”
সমাবেশের প্রস্তুতি খতিয়ে দেখতে এ দিন ব্রিগেডে গিয়েছিলেন বিমানবাবু, রবীন দেব, মানব মুখোপাধ্যায়, নিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়রা। সমাবেশে আসার পথে
বাম কর্মীদের তৃণমূল বাধা দিতে পারে বলে আগাম আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিমানবাবু। জেলার নেতাদের কাছ থেকে পাওয়া রিপোর্ট অনুযায়ী ভাল ভিড়ই আশা করছেন সিপিএম নেতৃত্ব। কিন্তু দক্ষিণবঙ্গের নেতাদের অভিযোগ, লরি বা বাসে করে আসা কর্মীদের বাধা সৃষ্টি করা হতে পারে। যে কারণে পুলিশ-প্রশাসনের উদ্দেশে বিমানবাবু বলেছেন, “গণতন্ত্রে কোনও রাজনৈতিক দলের সভা বা জমায়েতের অধিকার রয়েছে। ব্রিগেডে আগত কর্মীদের যাতে কোনও ভাবেই বাধা দেওয়া না হয়, পুলিশ-প্রশাসনকে তা দেখতে হবে।”
তৃণমূলের ব্রিগেডের সময় দূর জেলা থেকে আসা কর্মীদের থাকার জন্য সল্টলেক স্টেডিয়াম ব্যবহার করতে দেওয়া হয়েছিল। বিমানবাবুর অভিযোগ, তাঁদের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে লিখিত আবেদন করে প্রয়োজনীয় খরচ মিটিয়ে দেওয়ার কথা বলার পরেও রাজ্য সরকার কোনও উত্তর দেয়নি। এই অবস্থায় দূরের জেলা থেকে আসা মানুষ বিভিন্ন স্টেশন এবং ব্রিগেডের ক্যাম্প-অফিসে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। রাজ্য সরকার অবশ্য বিজেপি-কেও সল্টলেক স্টেডিয়াম ব্যবহারের অনুমতি দেয়নি।
তৃণমূল বা বিজেপি-র মতো তিনটে করে মঞ্চ নয়। বামেদের সমাবেশে ব্রিগেডে আজ মূল একটিই মঞ্চ থাকছে। তার সামনে থাকছে একটি ছোট সাংস্কৃতিক মঞ্চ। থাকছে শহিদ স্তম্ভও।
বিমানবাবুর বক্তব্য, সমাবেশের জন্য তাঁরা পরিচ্ছন্ন মাঠ পাননি। কিন্তু সভার পরে মাঠ পরিষ্কার করেই সেনার হাতে তুলে দেওয়া হবে। বামেদের এই সমাবেশের দিন রবিবার হলেও যানজটে সমস্যা হবেই। তৃণমূল ও বিজেপি-র ব্রিগেড সমাবেশ অবশ্য কাজের দিনে ছিল। ওই দুই দলকে কটাক্ষ করেই বিমানবাবু বলেছেন, “মানুষের অসুবিধা যাতে কম হয়, তার জন্য আমরা ছুটির দিন সমাবেশ করছি। তা-ও যানজট সৃষ্টি হতে পারে বলে মানুষের কাছে আগাম দুঃখপ্রকাশ করছি।” শিয়ালদহ, হাওড়া, উত্তর ও মধ্য কলকাতার বিভিন্ন জায়গা থেকে সকাল ১১টার পরই মিছিল শুরু হবে। ফলে যানজট বাধবে। স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য বিমানবাবুর নির্দেশ, “মিছিলের মধ্যে আ্যাম্বুলেন্স পড়লে অবশ্যই তা ছেড়ে দিতে হবে।” |