|
|
|
|
|
|
রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ৪... |
সুস্নাত চৌধুরী |
ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বিদ্যার সাগর ছিলেন। আবার টাকাপয়সাও তাঁর কম ছিল না। অধ্যাপনা করে নয়, সেই পয়সা তাঁর এসেছিল ব্যবসা করে। বইয়ের ব্যবসা। ১৮৪৭ সাল নাগাদ বন্ধু মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সঙ্গে পার্টনারশিপে খুলেছিলেন সংস্কৃত প্রেস ও ডিপজিটারি। বই ছাপা আর বই বিক্রির কারবার। লাভ কেমন ছিল সেই ব্যবসায়? পাটিগণিতটা চাকরি বনাম ব্যবসা অনুপাতে গেলেই সরল হয়ে যায়। ১৮৫৪ সালে সংস্কৃত কলেজে বিদ্যাসাগরের মাসিক বেতন দাঁড়ায় তিনশো টাকা। এর দু’বছর পর স্কুল পরিদর্শন বাবদ যোগ হয় আরও দুশো টাকা করে। অথচ বইয়ের ব্যবসা থেকে তখন তাঁর আয় প্রতি মাসে চার-পাঁচ হাজার টাকা! প্রায় দশ গুণ! নিঃসন্দেহে বিরাট সাফল্য। কিন্তু তাঁর গায়েই যদি ‘ধান্দাবাজ’ আর ‘ছকবাজ’-এর লেবেল সেঁটে যায়, তখন?
অভিযোগটা মারাত্মক বিপুল এই লাভ নাকি তিনি সোজা পথে করেননি, শিক্ষাব্যবস্থায় উঁচু পদে থাকার ভরপুর ফায়দা তুলেছেন! এক দিকে তিনি সুপারিশ করছেন স্কুল-কলেজে কী পড়ানো হবে। বাংলা শিক্ষা প্রসারের জন্য কী ধরনের বই পাঠ্য হবে, তার পরামর্শদাতাও তিনিই। আবার তিনিই পাঠ্যবইয়ের প্রকাশক, লেখকও। ডিমান্ড আর সাপ্লাই কি তা হলে সত্যিই ছিল তাঁর বাঁ-হাত আর ডান-হাতের খেলা? শুনে বিশ্বাসই হতে চায় না তাঁর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত পঁয়ত্রিশ বছরে বর্ণপরিচয়ের ১৫১টি সংস্করণ ছাপা হয়েছিল! এই কাটতি যেমন বাংলার শিক্ষা বিস্তারের প্রমাণ, হয়তো তেমনই বিদ্যাসাগরের ‘ফুলপ্রুফ স্কিম’-এরও। বিদ্যাসাগরের রিপোর্ট মোতাবেক সংস্কৃত কলেজের পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচি ঢেলে সাজা, নর্মাল স্কুলে ‘বোধোদয়’ কি ‘শকুন্তলা’-র মতো প্রায় সবই সংস্কৃত প্রেস ও ডিপজিটরির বই চালু করা, নিজে স্কলারশিপ পরীক্ষার পরীক্ষক হয়ে নিজের বই থেকেই পরীক্ষা নেওয়া এ সব কাণ্ডের রমরমায় লোকের জিভ নড়বেই!
এ যুগেও যুক্তি আর তথ্য দিয়ে ‘ব্যবসায়ী বিদ্যাসাগর’কে ঘিরে এমনই জাল বুনেছেন প্রাবন্ধিক পরমেশ আচার্য। এ-ও দেখিয়েছেন, সাহেবসুবোদের গুডবুকে থাকাটাও বিদ্যাসাগরের ব্যবসার পক্ষে ঢের সুবিধের হয়েছিল। ঋণ করে ব্যবসা শুরু হয়েছিল বটে, কিন্তু তার পরই সরকারের থেকে অগ্রিম দাম বা বিক্রির আগাম বরাত পেয়ে ছাপা হয় বই। ঝুঁকি সেখানে প্রায় ছিল না বললেই চলে। ‘ক্যাচ’ না থাকলে কি সম্ভব! আবার সংস্কৃত প্রেস ও ডিপজিটরির প্রথম বই-ই ছিল ‘অন্নদামঙ্গল’। বটতলার হটকেক। এ দিকে তারই অন্তর্গত ‘বিদ্যাসুন্দর’ পড়াতে নাকি রীতিমত সংকোচ বোধ করতেন তিনি নিজেই খেউড় অংশে ছাত্রদের সামনে তাঁর এই ‘কাতুমাতু’ করার কথা লিখেছেন কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য।
সরকারি সুযোগ অপব্যবহারের আরও কথা রটে। এমনও শোনা যায়, তিনি সরকারি খামে নিজের লেখা বই পুরে অন্যত্র পাঠিয়েছেন। এ খবরে চটে গিয়ে শিক্ষা বিভাগের ডিরেক্টর গর্ডন ইয়ং ছোটলাটের কাছে নালিশও করেন। এই ইয়ং-এর সঙ্গে বহু বারই মতবিরোধ হয়েছে বিদ্যাসাগরের। ইয়ং সাহেব বলতেন, শিক্ষা বিস্তারের জন্য কম দামে বই দিতে গেলে মুনাফা-লোভী সংগঠনের বদলে নির্ভর করতে হবে ‘স্কুল বুক সোসাইটি’-র মতো প্রতিষ্ঠানের ওপর। বিদ্যাসাগর তা মানেননি। ‘বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ’-এ বিনয় ঘোষের মতো প্রো-বিদ্যাসাগর মানুষও লিখছেন, ‘এক্ষেত্রে তাঁর বৈষয়িক বুদ্ধিই সজাগ ছিল বেশি!’ কেন না, এই অভিযোগও তো শোনা যায়, সুযোগ বুঝে বিদ্যাসাগর বইয়ের দাম বাড়িয়ে দিতেন! ১৮৫৬ সালে বিভিন্ন স্কুলের সমস্যা খতিয়ে দেখতে একটি কমিটি তৈরি হয়। তার রিপোর্ট থেকেই স্পষ্ট, এমনিতেই বিদ্যাসাগরের প্রকাশনার বইগুলির দাম ছিল চড়া, আবারও সেই দাম বাড়ানো হয়েছিল।
এ হেন বিত্তসাগর হয়ে ওঠা বিদ্যাসাগর নাকি গ্রামের বাড়িতে ইনকাম ট্যাক্স অফিসারকে নিমন্ত্রণ করে খাইয়েছিলেন! এ কাহিনিতেও আঁশটে গন্ধ, কিন্তু সবচেয়ে বড় ঘটনা বোধহয় তাঁর ব্যবসার পার্টনার ও বন্ধু মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সঙ্গে বিচ্ছেদ। তর্কালঙ্কারের মৃত্যুর পর ‘শিশুশিক্ষা’-র কপিরাইটের টাকা বিদ্যাসাগর বেমালুম মেরে দিয়েছেন, এই অভিযোগ তোলেন তর্কালঙ্কারের জামাই যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ। উকিলের চিঠিও পান বিদ্যাসাগর। অভিযোগ খণ্ডন করতে গোটা একটি পুস্তিকাই লিখতে হয় তাঁকে: ‘নিষ্কৃতিলাভপ্রয়াস’।
তাঁর বিখ্যাত উক্তি ছিল ‘সে কি রে আমার নিন্দা! আমি ত তাঁহার কোন উপকার করি নাই।’ ধাঁধা? না কি একটা এসকেপ রুটই খুলে রাখতে চেয়েছিলেন বিদ্যাসাগর? |
|
|
|
|
|