রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ৩...
গিরিশ কাসারাভল্লি
কাসারাভল্লি, মধ্য কর্নাটকের একটা ‘মালে নাড়ু’ (পাহাড়ের রাজ্য) গ্রাম। ওখানেই আমার জন্ম। গোটা গ্রামে ছিল মোটে সাতটা বাড়ি। ছ’কিলোমিটার দূরের স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পর কথা বলার মতো কাউকে পেতাম না। ফলে আমরা ভাইবোনেরা কন্নড় ভাষায় লেখা গল্পের বইয়ের পাতায় নিজেদের ডুবিয়ে দিতাম।
আমার বাবা একটা চমৎকার লাইব্রেরি বানিয়েছিলেন। সেটা ষাটের দশক। আমি হাই স্কুলের পড়ুয়া। তখন কন্নড় সাহিত্যে ‘নব্য’ (আধুনিক) আন্দোলন তুঙ্গে। প্রচুর নতুন লেখক গল্প আর কবিতা লিখছেন। ওই সময়ই আমি পড়ে ফেলি ইউ আর অনন্তমূর্তির ‘ঘটশ্রাদ্ধ’। তিনি নিজেও মালে নাড়ু অঞ্চলেরই মানুষ। সুতরাং গল্পের প্লট, চরিত্র, পরিবেশ সব কিছুই আমার খুব পরিচিত। গল্পটা রক্ষণশীল সমাজের উদ্দেশে কড়া আক্রমণ শানিয়েছিল। ওই সমাজেই আমি ছোটবেলা কাটিয়েছি।
পরে, আমি পুণে-র ফিল্ম অ্যান্ড টিভি ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়াতে ভর্তি হই। সেখানে ডিপ্লোমা পেতে গেলে পরীক্ষার অংশ হিসেবে আমাদের একটা স্ক্রিপ্ট জমা দিতে হত। আমি ওই গল্পটাই বেছে নিলাম এবং স্ক্রিপ্ট জমা দিলাম। পরীক্ষক ছিলেন গিরিশ কারনাড এবং নবেন্দু ঘোষ। তাঁরা জানালেন, স্ক্রিপ্টটা দাঁড়ায়নি। লেখাটায় তেমন আবেদন নেই। আমাকে অন্য চিত্রনাট্য জমা দিতে বললেন। আমি রাজি হলাম না। বরং তর্ক জুড়ে দিলাম, শব্দের বদলে চিত্রকল্পের দিকে নজর দেওয়া হোক। তাঁরা অবশ্য গললেন না। এর পর আমি অন্য বিভাগে অন্য একটা চিত্রনাট্য জমা দিলাম। সেটা থেকে তৈরি আমার স্টুডেন্ট ফিল্মটি সে বছরের সেরা নিরীক্ষামূলক স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবির ‘রজত কমল’ পুরস্কার জিতে নেওয়া সত্ত্বেও, থিয়োরি পেপারে আমি প্রথম হওয়া সত্ত্বেও, আমার ডিপ্লোমা আটকে দেওয়া হল, চিত্রনাট্য-বিচারকদের সঙ্গে ওই খটাখটির জন্য। আমি আজও এফ টি আই আই-এর ডিপ্লোমাধারী নই। ওই দিনই ঠিক করে ফেললাম, এটা দিয়েই ছবি বানাব, আর প্রমাণ করে দেব স্ক্রিপ্টটা খারাপ ছিল না।
আমি বেঙ্গালুরু ফিরে এলাম এবং স্ক্রিপ্টটা কয়েকজন প্রযোজককে দেখালাম। প্রত্যেকেরই মনে হল, এতে তেমন ‘ড্রামা’ নেই। তখন একজন প্রথম সারির সিনেমাটোগ্রাফার ছিলেন এস রামচন্দ্র (এফ টি আই আই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত)। তাঁর কিন্তু মনে হল, স্ক্রিপ্টটা অসাধারণ। এর পর আমি দেখা করলাম সদানন্দ সুবর্ণ-র সঙ্গে। মুম্বই থেকে আসা এই মানুষটির গাড়ি রং করার একটা দোকান ছিল। তিনি আমার স্ক্রিপ্টটা পড়ে এত অভিভূত হয়ে গেলেন যে, ছবি বানানোর প্রস্তাব দিয়ে বসলেন।
তবে সবচেয়ে বড় মানসিক জোরটা পেলাম স্বয়ং লেখকের কাছ থেকে। আমেরিকা থেকে ফিরে তিনি স্ক্রিপ্টটা দেখতে চাইলেন। আমার মাত্র পঁচিশ বছর বয়সটা বোধহয় তাঁকে খানিকটা খুঁতখুঁতে করে থাকবে। কিন্তু স্ক্রিপ্টটা পড়ার পর তিনি জনে জনে বলে বেড়াতে লাগলেন, আমি গল্পটা থেকে চমৎকার চিত্রনাট্য বানিয়েছি। অবশ্য এটা মূল গল্পের প্রতি খুব একটা অনুগত থাকেনি। তবে সঙ্গে এটাও বললেন, চিত্রনাট্য যদি পুরোপুরি গল্পকে অনুসরণ করে, তা হলে সেটা খারাপ চিত্রনাট্য। আমার কাছে এই কথাগুলো ‘বেদবাক্য’র মতো ছিল। আমার তৈরি বাকি বারোটি ছবির কোনওটির সঙ্গেই মূল গল্পের সম্পূর্ণ সাদৃশ্য নেই। তা সত্ত্বেও সমস্ত লেখকই দিব্যি খুশি।
সুবর্ণ ছবিটা প্রযোজনা করতে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু ছবির খরচ বাবদ মাত্র দু’লাখ টাকা জোগাড়ও সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সুবর্ণ লাখখানেক টাকার কিছু বেশি জোগাড় করতে পেরেছিলেন। শেষ পর্যন্ত একটা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক (সিন্ডিকেট ব্যাঙ্ক) ঋণ দিতে রাজি হয়। সুতরাং দু’লাখ টাকার বাজেট নিয়ে আমরা ছবিটা শুরু করি। যদিও শেষ পর্যন্ত বাজেট ছাপিয়ে আরও কুড়ি হাজার টাকা খরচ হয়ে যায়।
টাকা তো জোগাড় হল, এ বার লোকেশন খুঁজে বের করতে হবে। ভীষণ সমস্যায় পড়লাম। পবিত্র শহর শৃঙ্গেরি-র কাছে কিছু অগ্রহার (যে গ্রামে কেবলমাত্র ব্রাহ্মণরাই বাস করেন) গ্রাম আমাদের পছন্দ হয়েছিল। কিন্তু স্থানীয় ব্রাহ্মণরা কিছুতেই ‘ঘটশ্রাদ্ধ’ নামে কোনও ছবি ওখানে তুলতে দেবেন না। তার ওপর তাঁরা যখন শুনলেন, এটা ইউ আর অনন্তমূর্তির গল্পের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হচ্ছে, আরও রেগে গেলেন। অনন্তমূর্তির গায়ে তখন ‘ব্রাহ্মণ-বিদ্বেষী’র ভয়ংকর তকমা সেঁটে গিয়েছে।
অন্য কোনও জায়গা না পেয়ে আমি ঠিক করলাম, আমার পৈতৃক বাড়িতেই শুটিং হবে। ভাইয়েরা সম্মতি জানাল, কিন্তু অন্য আত্মীয়স্বজন নয়। আমার জ্যাঠামশাই সে সময় রক্ষাকর্তা হিসেবে এগিয়ে এলেন। তিনি বিরাট পরিবারের সবাইকে ডেকে বললেন, ‘আমাদের নিজেদের ছেলেটা তার প্রথম ছবি শুরু করছে, তার পাশে তোমরা দাঁড়াচ্ছ না?’
আর এক জন মানুষ যে আমাকে সমর্থন করেছিল, সে সম্পর্কে আমার তুতো ভাই। ও ছিল সম্পন্ন চাষি। তা সত্ত্বেও শখের থিয়েটারে অভিনয় করে অনেকের প্রশংসা কুড়িয়েছিল। সে মজা করে বলেছিল, ও আমার পক্ষ নেবে, কিন্তু বিনিময়ে ওকে অভিনয়ের সুযোগ করে দিতে হবে। আমি রাজি হলাম। একটা দৃশ্যে মাত্র দু’মিনিটের জন্য ওকে দেখা যাবে। এটা আবার অন্য গ্রামবাসীদের আরও খেপিয়ে দিল। সুতরাং আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, আমাদের প্রথম শিডিউলের শেষ দিনে ওর দৃশ্যটা তোলা হবে। ও এত উত্তেজিত হয়ে পড়ল যে, পুরো ইউনিটকে নিয়ে প্রচুর খরচ করে একটা লাঞ্চ আয়োজন করল। কিন্তু দুর্ভাগ্য, শুটিংয়ের ঠিক আগের দিনই ও মারা গেল, ভয়ংকর হার্ট অ্যাটাকে।
এই খবরটা বেঙ্গালুরুতেও পৌঁছেছিল। কোনও ডিস্ট্রিবিউটর আমাদের ছবিটাকে ছুঁতেই রাজি হলেন না। বললেন, ওই যে নামে ‘শ্রাদ্ধ’ কথাটা আছে, ওটাই খুব অশুভ। আমরা তর্ক জুড়ে দিলাম যে, ‘সংস্কার’ তো ভালই চলছে। ওর নামের মানেও তো ‘দাহকাজ’। অমনি তাঁরা নিজেদের সমর্থনে আমার তুতো ভাইয়ের মৃত্যুর উদাহরণ দিয়ে বসলেন। আট মাস পরেও কোনও ডিস্ট্রিবিউটর না পেয়ে আমরা একেবারে হতাশ হয়ে পড়লাম।
‘শ্রাদ্ধ’ একটা মৃত্যু-সম্পর্কিত আচার। আর ‘ঘটশ্রাদ্ধ’ হল সমাজের চোখে কেউ ভুল কাজ করলে তাকে জাতিচ্যুত করা। এখানে একটা পাত্রকে প্রতীকী ভাবে ভেঙে ফেলা হয়, যাতে ধরে নেওয়া হয় ওই মানুষটি মৃত। আর শ্রাদ্ধে তিনটি কুম্ভ (কলসি) ‘প্রসাদম’ (প্রসাদ) হিসেবে উৎসর্গ করা হয়। প্রতিটি কলস এক জন মৃত মানুষের চিহ্ন বহন করে যে মানুষটির মৃত্যু হয়েছে তিনি নিজে, তাঁর বাবা এবং ঠাকুরদা। আমরা এক জন পুরোহিতকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম এইগুলো দেখেশুনে দেওয়ার জন্য, যাতে কোনও ত্রুটি থেকে না যায়। তিনি বললেন, ‘ঘটশ্রাদ্ধ’-র জন্যও তিনটি কলসি রাখা হোক। তখন মূল অভিনেত্রী মীনা তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিল, তিনটে কলসি রাখা হবে কেন? শুধুমাত্র এক জনকেই তো জাতিচ্যুত করা হয়েছে, তাঁর বাবা বা ঠাকুরদাকে তো করা হয়নি! পুরোহিত কোনও উত্তর দেননি। তখন ও বার বার আমাকে খোঁচাতে লাগল, কেন তিনটে কলসি? অন্য দুটো কাদের জন্য? আমি এত রেগে গেলাম, চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘একটা কলসি নায়কের, একটা প্রযোজকের, আর তৃতীয়টা পরিচালকের। ছবিটার পর ওদেরও জাতিচ্যুত করা হবে কিনা।’ এখন ডিস্ট্রিবিউটর না পেয়ে আমি প্রযোজক সুবর্ণকে লিখলাম, আমার রাগের কথাটাই তা হলে সত্যি হল! এটাই আমাদের প্রথম আর শেষ ছবি। হয়তো কোনও দিনই ছবিটা মুক্তির আলো দেখবে না আর আমরাও অন্য ছবি বানাতে পারব না।
কিন্তু আমাদের সমস্ত হতাশা কেটে গেল ছবিটার মুক্তির পর। কন্নড় প্রেস খুবই উৎসাহ দিয়ে রিভিউ লিখল। একটি কাগজ লিখল, এ দশকের সেরা ছবি। এম এস সথ্যু প্রেস ইন্টারভিউয়ে বললেন, সর্বকালের সেরা কন্নড় ছবি। দর্শকরাও চমৎকার ভাবে ছবিটি গ্রহণ করেছিলেন। অবশ্য ব্রাহ্মণদের কিছু গোষ্ঠীর তরফ থেকে প্রতিবাদ উঠেছিল। ১৯৭৭-এ ছবিটি সেরা চলচ্চিত্রের রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘স্বর্ণ কমল’ পায়। ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটি এর প্রিন্ট কিনে সারা দেশে দেখানোর ব্যবস্থা করে। বেঙ্গালুরুর এক ফিল্ম সোসাইটি এর ওপর আলোচনাচক্র আয়োজন করে, কর্নাটকের ছবিতে এই প্রথম। আর ২০০৯-এ গোয়ার আন্তর্জাতিক ফিল্মোৎসবে ছবিটি ভারতীয় সিনেমার একশো বছরে সেরা কুড়িটি ছবির তালিকায় ঠাঁই করে নেয়।
এফ টি আই আই-এর পরীক্ষকদের হাতে বাতিল হয়ে যাওয়া আমার সেই চিত্রনাট্যই রাজ্যের ফিল্ম প্রতিযোগিতায় সেরা চিত্রনাট্যের পুরস্কার জিতে নেয়। সবচেয়ে বড় পরিহাস এটাই।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.