১৯৫৫ সাল। আমার বয়স তখন বছর ছয়েক। ধার করে আনা দম-ঘোরানো গ্রামোফোনে বাবা দিলীপ কুমার রায়, বড়ে গোলাম আলি খান, বেগম আখতারের গানও শুনছেন, আবার একটি ইংরিজি গানও শুনছেন বার বার। কথা বুঝতে পারছি না। সুরটা বড় ভাল লাগছে। সত্যি বলতে, আগের তিন জনের গলার প্যাঁচ আর গিঁট লাগানো গানগুলোর চেয়ে এই গানটা বেশি ভাল লাগছে। সুরটি কাছে ডেকে নিচ্ছে আমায়। বাজনাগুলো কী নরম। তালযন্ত্রটা যেন প্রায় বাজছেই না, অথচ তালটা আমি পাচ্ছি। আমাদের দেশের গানবাজনায় তালযন্ত্র অনেক সময়ে বড় ধাঁইধপাধপ-রামখটাখট। কোনও কোনও বাংলা ব্যান্ডের ড্রাম্স-এর মতো— এমন জোরে সুপার-রামখটাখট-দুড়ুমদড়াম বাজে যেন ওই দলের যন্ত্রীরা ধরে নিয়েছেন সারা দুনিয়ার মানুষ কানে খাটো। ছেলেবেলায় নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘চারমূতির্’র কোনও এক গল্পে পড়া এক সাধুবাবার নাম মনে পড়ে যায়: ‘ডমরু-ঢক্কা-পট্টনানন্দ’। ব্যান্ডশিল্পীরা রাগ করবেন না। ছেলেবেলা থেকে আজ অবধি সেতার সরোদের অনুষ্ঠানে ‘ঝালা’ অংশটি শুনে অনেক সময়ে ওই নামটাই মনে পড়ে গেছে আমার।
ইংরিজি গানটির গায়িকার গলা ও গায়কি নরম। অদ্ভুত এক উষ্ণতায় ভরা। মহিলাকণ্ঠ। কিন্তু একেবারেই মিহি নয়, চিকন নয়। যাকে বলে ‘মেয়েলি’ নয়। মেয়েরা আমায় বৈষম্যবাদী ভাববেন না, দোহাই। ইদানীং অনেক ছেলের গলার আওয়াজে আর গায়কিতে আমি এক ধরনের আরোপিত মেয়েলি ভাবই বেশি পাই। এই ইংরিজি গানের গায়িকার গলা, শুনতে শুনতে টের পাচ্ছি, আমাদের সুপ্রভা সরকারের গলার কাছাকাছি, যদিও তার চেয়েও এক পোঁচ ভারী। গ্রামোফোনের বাঁকানো ঝকঝকে রুপোলি হাতটা সযত্নে তুলে সরিয়ে নিয়ে যেতে যেতে বাবা বলছেন ‘মার্লেন ডীত্রিশ।’ দীর্ঘশ্বাস। ‘বুঝলি তো, সে এক যুগ ছিল বটে। জার্মান মেয়ে ইংরিজি ছবিতে। গলায় যেমন সুর, গায়কিতে যেমন মেজাজ, উচ্চারণে তেমনি মাদকতা। সব মিলিয়ে (দীর্ঘশ্বাস)— নেশা। সব্বোনেশে নেশা।... আর, সে-কী ছবি। ‘ব্লু এঞ্জেল’। ডীত্রিশের যেমন গান তেমনি অভিনয়।’
তার পর প্রায় ষাট বছর বাঁচলাম। ইউ টিউবে Marlene Dietrich-এর Falling in Love Again শুনতে শুনতে আজও সেই মাদকতাই টের পাচ্ছি। স্বপ্নে-শোনা কণ্ঠে, মহারানির মেজাজে কথা আর সুরগুলোকে অমোঘ ভাগ্যবাণীর মতো মহাকালের স্রোতে আলতো করে ভাসিয়ে দেওয়া— এমন মানবজনম আর কী হবে? ‘মন যা করার ত্বরায় করো এই ভবে।’ লালন তো গেয়ে খালাস। আমি? এই ভবে কী যে করার আছে তা ভাল করে ভেবেই দেখা হল না। ভাবতে শুরু করলেও কোথাও না কোথাও সব গুলিয়ে যায় এক-একটা গান বা মুহূর্তের জন্য। আমার কাছে আবার স্মরণীয় মুহূর্ত মানেই গান ও বাজনা, অনেক সময়ে বাজনার অনুষঙ্গ। |
ক্লাস নাইনে উঠেছি। স্কুল পালিয়ে দেখতে গিয়েছি ‘চাওয়া পাওয়া’। এক বিশেষ মুহূর্তে বড়লোকের ক্রুদ্ধ কন্যার ভূমিকায় সুচিত্রা সেন হঠাৎ ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন। হল জুড়ে হাহাকার-আর্তনাদ-আর্তি-গুঞ্জন মেশানো একটা ধ্বনি উঠল। মুহূর্ত বটে। কিন্তু পরে এক সাজানো বিয়েতে নববধূর বেশে সেই সুচিত্রাই যখন গাইছেন ‘খেলা নয়’ (প্লে-ব্যাক শিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়)— হে লালন, এ বারে বলে দাও ‘এই ভবে’ করার কী আছে। ‘খেলা নয়, নয়, ন—য়’: ‘নয়’ কথাটির ওপর সুরের তিনটি variation; অথবা, অন্য একটি ছায়াছবিতে (‘সূর্য্যতোরণ’ কি?) পিয়ানো বাজিয়ে সুচিত্রা সে গান ধরেছেন ‘আমি এ আঘাত আর সহিতে পারি না ওগো অকরুণ।’ বাংলায় একটি মাত্র কথা আছে, যা এ মুহূর্তে খাটে: ‘উফ্’।
অস্তিত্বের একেবারে ভেতর থেকে উঠে আসা এই উফ্-ধ্বনিটি কেন? আমি বলব, ওই গানটি যে ভাবে, যে ভঙ্গিতে সুচিত্রা সেন তাঁর ঠোঁট-মুখ-চোখের চাহনি, দেহের উপরিভাগের অভিব্যক্তি এবং তাঁর দুটি হাত দিয়ে পেশ করলেন সেই জন্য। রবীন্দ্রনাথের ‘আমার রাত পোহালো শারদপ্রাতে’ গানটির সুর ও ছন্দের গন্ধমাখা ‘আমি এ আঘাত আর সহিতে পারি না’-র আবেদন এতটাই যে, আমার অন্তর তাতেই প্লাবিত। চোখ বুজে শুনলেও ছায়াছবির ওই মুহূর্তের আবেদন আমার কাছে কম হত না। তা হলে, প্রশ্ন— সুচিত্রা সেন বা কোনও অভিনেতার কি কোনও ভূমিকাই নেই? আছে বই কী। গানটি তাঁরই, তাঁরই মনের কথা বলছে— এই ভাব অভিনেতা তাঁর অভিনয়নৈপুণ্যের মধ্য দিয়ে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলবেন— এই হল চ্যালেঞ্জ। চোখ বুজে শুনলে দেখা হত না সুচিত্রা সেন কী ভাবে সেই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করছেন।
নিজের জীবনে গান না থাকলে, নিজে অল্পস্বল্প হলেও গান না গাইলে ভাল ‘লিপ’ দেওয়া মুশকিল। বাংলা চলচ্চিত্রশিল্পে সুচিত্রা সেন এসেছিলেন অভিনয় করতে চেয়ে নয়, প্লে-ব্যাক গায়িকা হতে চেয়ে। ছবির পরিচালক তাঁকে দিয়ে অভিনয় করান। ছবিটি অবশ্য বেরোয়নি।
‘Falling in Love Again’-এর মার্লেন ডীত্রিশের মতো সুচিত্রা সেন কি ‘সিংগিং স্টার’ হতে পারতেন? গ্ল্যামারের দিক দিয়ে সমতুল্য। গান গাওয়ার দিক দিয়ে? বাংলার সেরা সিংগিং স্টার কানন দেবী সম্পর্কে খবর নিলে আমরা দেখতে পাব, তিনি রীতিমত সংগীতশিক্ষা নিয়েছিলেন। তালিম নিয়েছিলেন আল্লা রাখা নামে এক ওস্তাদের কাছে, ট্রেনিং পেয়েছিলেন রাইচাঁদ বড়ালের কাছে, গান শিখেছিলেন ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছে, রবীন্দ্রনাথের গানে পেয়েছিলেন অনাদি দস্তিদারের তালিম। তিনিই সম্ভবত অবিভক্ত ভারতের প্রথম ‘সিংগিং সুপারস্টার।’— এই হিসেবে ‘ব্লু এঞ্জেল’ ছবিতে লোলা-র ভূমিকায় অভিনয় করে এবং গান গেয়ে (‘Falling in Love Again’) বিশ্বজয় করা মার্লেন ডীত্রিশ (জার্মানিতে জন্ম, পরে মার্কিন নাগরিক) আর কানন দেবীকে বরং পাশাপাশি বসানো যায়।
কানন দেবীর মতো সংগীতশিক্ষা সুচিত্রা সেনের ছিল কিনা জানি না। জানি শুধু, পঞ্চাশের দশকে রবিন চট্টোপাধ্যায়ের সুরে তাঁর গাওয়া দুটি আধুনিক বাংলা গানের রেকর্ড বেরিয়েছিল: ‘আমার নতুন গানের নিমন্ত্রণে আসবে কি’ আর ‘বনে নয় আজ মনে হয়’। সে সময়ে শুনেওছিলাম। ‘নতুন গানের নিমন্ত্রণে’র সুরটি বেশ ভাল লেগেছিল বলে পুরো সুর, এমনকী যন্ত্রানুষঙ্গের সুরও মনে আছে। পিয়ানোয় ছিল সংক্ষিপ্ত প্রিলিউড। আর ইন্টারলিউড ছিল বিভিন্ন যন্ত্রের সমারোহে জমকালো।
‘বনে নয়’ গানটি ছিল সে যুগের কোনও জনপ্রিয় সাহেবি নাচের তালে-ছন্দে, ছোট ছোট টুকরোয় ছন্দমাফিক ভেঙে নেওয়া সুরে। সুচিত্রা সেনের গলার আওয়াজ মিঠে শোনালেও অর্কেস্ট্রার ধ্বনিময় সমারোহে তাঁর গায়কি শুনিয়েছিল দুর্বল। ভাগ্যিস তিনি প্লে-ব্যাকে আসার জন্য জোরাজুরি না করে অভিনয়ে চলে গিয়েছিলেন। |