স্কুল-কলেজে লাস্ট বেঞ্চে বসতাম। অফিসেও বেঞ্চে বসি। আমার লুই ফিলিপ আর ব্ল্যাকবেরি ঝাঁপিয়ে উঠে সামনের ওই কেবিনগুলোতে বসতে চায়, যেখানে ‘বেঞ্চ’-এর তকমা লাগানো নেই। এঁটুলির মতো আঁকড়ে ধরতে চায় ওই কোড-লেখা এলসিডি স্ক্রিনগুলো। পারে না।
বছর পাঁচেক হবে। মধ্য রাতে ফুটপাথ বদল হয়। আর আমার চাকরি হয়েছিল। রাত দেড়টা তখন। বিকেল চারটে থেকে শুরু হওয়া ক্যাম্পাসিং তখনও চলছে। আমার ডাক পড়ল। তিরাশি নম্বরে ছিলাম। আমি ক্লান্ত। ইন্টারভিউ হলে গিয়ে দেখলাম আমার থেকে আরও ক্লান্ত প্যানেল মেম্বাররা। আমি ‘হাই স্যরস্’ বললাম। দুজন হাই তুলল। ‘নেম?’ নাম বললাম। এক জন প্যানেল মেম্বার জিজ্ঞেস করল, ‘হবি কী তোমার?’ আমি বললাম, ‘সিংগিং স্যর।’ বলল, ‘একটা গান গাও তো জম্পেশ করে।’ খানিক ইতস্তত করে একটা জীবনমুখী শুরু করলাম। চোখ বুজে দু-তিন লাইন গাওয়ার পরেই দেখি এক জন বলছে, ‘ঠিক আছে। নেক্সট যে আছে পাঠিয়ে দাও।’ ঝটকা লাগল। এই ধরনের ইন্টারভিউতে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং ল্যাংগোয়েজের ওপর চোখা চোখা প্রশ্ন করা হয়। মনে কু ডাকল। গানটা পছন্দ হল না নাকি?
পরের দিন কলেজে হুড়োহুড়ি। কালকে যারা আমাদের ইন্টারভিউ নিয়ে গেল, তারা রেজাল্ট মেল করে দিয়েছে এইমাত্র। মা কালীকে ডাকলাম। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই সাত-আটটা কাগজ নিয়ে আমাদের টিপিও, অর্থাৎ ট্রেনিং অ্যান্ড প্লেসমেন্ট সেল অফিসার নোটিস বোর্ডের দিকে হাঁটা লাগালেন। আর হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালার গল্পের ইঁদুরের মতো আমরা, আড়াইশো-তিনশো উড-বি বি টেক তাঁকে ফলো করলাম। বোর্ডে কাগজ সাঁটা হল, আর আমি ভিড় গলে পৌঁছনোর আগেই উলটো দিক থেকে আসা ইলেকট্রনিক্সের নিবেদিতাকে বলতে শুনলাম, কনগ্র্যাট্স ইয়ার। বিশ্বাস হচ্ছিল না। চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি বেলা শুনছ! |
তবে এখন একটা ব্যাপার বেশ বুঝি। ২০০৭ সালের নভেম্বর তখন। সফ্টওয়্যার দুনিয়ায় জোয়ার এসেছে। আমাদের চাকরির দরকার যতটা ছিল, কোম্পানিগুলোর আমাদেরকে দরকার ছিল হয়তো তার চেয়েও বেশি। সে দিনই শুনেছিলাম, ওরা ইন্টারভিউয়ে প্রথম কুড়ি-পঁচিশ জন ছাড়া আর কারও টেকনিকাল রাউন্ডটাই নেয়নি। ইলেকট্রিকালের সুদীপ্ত বলেছিল, ‘গুরু আমি তো তিরঙ্গা চিবোতে চিবোতেই ইন্টারভিউটা মেরে দিলাম। রাত দুটোয় ও সব ম্যাটার করে না!’
আমাদের কলেজে মোট তিনশো জন ছিল। সবার চাকরি হয়ে যেতে মাসখানেকের বেশি সময় লাগেনি। কিন্তু কোম্পানির লাইন লেগেই থাকত। এর ফলে, মাসদুয়েকের মধ্যেই প্রত্যেকের হাতে, গড়ে দুটো করে অফার লেটার! ফাইনাল ইয়ারে উঠে পড়াশোনা একেবারে ছেড়ে দিলাম। কী হবে? চাকরির জন্যই তো পড়াশোনা!
ইদানীং কাগজগুলো পড়তে খুব রগড় লাগে। বিশেষ করে জয়েন্টের কাউন্সেলিং-এর খবরগুলো। দু-তিন রাউন্ড কাউন্সেলিং হয়ে যাওয়ার পরেও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলোতে কম করে টেন পার্সেন্ট সিট খালি পড়ে থাকে। শেষ দিকে অনেক কলেজই রাস্তা থেকে ডেকে ডেকে ছেলে তুলে এনে সিট ভর্তি করে।
রগড় লাগে কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভেতরে কে যেন পিন ফোটাল। আমি এই কথাটা বলতে পারলাম? আমি? শালা আমার নিজের অবস্থাটা কী? আমি তো ডেলি বসি বঞ্চিত বেঞ্চে। এত ক্ষণ পর্যন্তও যাঁরা বেঞ্চের মানেটা বুঝতে পারেননি, তাঁদের ধিক্কার জানাই। আমার মতো আপনাদেরও কিছু হবে না। গত কয়েক বছরে পশ্চিমবঙ্গে আর কিছু না হলেও পুকুরে কচুরিপানা বৃদ্ধির হারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হয়েছে। কম করে দশ-বারো হাজারের বেশি বি টেক তৈরি হচ্ছে এ রাজ্যে, ফি বছর। নামেই সিভিল, মেকানিকাল, আইটি, ইলেকট্রিকাল... এই সব নদীর জল গিয়ে মেশে একটাই সাগরে, তার নাম সফ্টওয়্যার। আজকের জমানায় এমন বাড়ি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি— যেখানে এক পিস ইঞ্জিনিয়ার নেই। আর যে কোনও ইঞ্জিনিয়ার, যার সেক্টর ফাইভ বা রাজারহাট নামে তীর্থক্ষেত্রে যাতায়াত আছে, তাকে ‘বাবু তুই কি বেঞ্চে বসিস’ কথাটা এক বার শুধিয়ে দেখুন!
পুল বোঝেন, পুল? না কোনও ওয়াটার বডি নয়, হিউম্যান রিসোর্স পুল। সফ্টওয়্যার ইন্ডাস্ট্রিতে যে কোম্পানির এই পুল যত বেশি গভীর, মানে লোকলশকর যত বেশি থিকথিকে, তার প্রোজেক্ট পাওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি। ক্লায়েন্টের সঙ্গে সফ্টওয়্যার কোম্পানিগুলির দর কষাকষির অন্যতম মাপকাঠি এই হিউম্যান রিসোর্স পুল। ধরা যাক, ক্লায়েন্ট একটা আইটি সলিউশন কোম্পানির কাছে কোনও সমস্যা বা প্রোজেক্ট নিয়ে হাজির হল। দেখা গেল, এই কাজের জন্যে দরকার পাঁচশো জন। অথচ সেই কোম্পানির রিসোর্স পুলে সেই মুহূর্তে সাড়ে আটশো জন। ক্লায়েন্ট ভাবল, বা রে বা, এদের অফিস তো মণিমাণিক্যে ভরপুর। প্রোজেক্টটা এদেরই দেওয়া যাক। আমাদের কোম্পানি আবার বিদেশি ক্লায়েন্টের সঙ্গে ডিল করতেই ভালবাসে বেশি। এখানকার ডিল হয় কোটিতে।
রাজারহাটে আমি যে অফিসটায় বসি সেটা পনেরো তলা। আমি কাজ করি চোদ্দো তলায়। আবার ভুল করলাম। সত্যি কথা বলতে, কার্ডটা পাঞ্চ করি চোদ্দো তলায়। কাজ নেই! অথচ কলেজ শেষ করে এই কোম্পানিতে জয়েন করার পরে সাত-আট মাস ধরে ট্রেনিং হল। আর তার পরেই প্রোজেক্ট পেয়ে গেলাম। সেটা শেষ হতে না হতে আরও একটা। দুটো প্রোজেক্ট মিলিয়ে প্রায় তিন বছর। তখন স্বপ্ন দেখতাম, এর পরের প্রোজেক্টটা নিশ্চয়ই ওভারসিজ হবে। সাত সাগর আর তেরো নদীর পারে। অন সাইট! আইটি চাকরির সব পেয়েছির দেশ। অথচ দুটো সাকসেসফুল প্রোজেক্টের পর আমি আর কিছু পেলাম না। শুনছি টেকনোলজি, আমাদের টেকনোলজি আজ অবসোলিট। সি প্লাস প্লাস, মেনফ্রেম নাকি আর চলে না। সুতরাং আমি বেঞ্চে। আর কয়েক মাস বেঞ্চ হয়ে গেলেই, গড সেভ মি, পিঙ্ক স্লিপ। কোম্পানি দু-তিন মাসের আগাম মাইনে দিয়ে বলবে, থ্যাংক ইউ ফর ইয়োর ভ্যালুয়েব্ল অ্যাসোসিয়েশন। এইচ আর বলবে ডাউনসাইজ্ড অথবা স্মার্টসাইজ্ড। আমি জানব পাতি ছাঁটাই।
আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি কে এসে দেখে যাবে? রাজারহাট-নিউটাউন-সেক্টর ফাইভমুখো হতে হয় রোজ। আমাদের অফিসের কম্পিউটারগুলোও শুধু কম্পিউটার নয়। এগুলো ওয়ার্কস্টেশন। আমারও আছে। ওয়ার্কস্টেশন। অফিসে এসে, কার্ডখানা সোয়াইপ করে, নিজের ফিংগারপ্রিন্ট দিয়ে ওয়ার্কস্টেশনটা অন করার সঙ্গে সঙ্গে উনিশ ইঞ্চি এলসিডি স্ক্রিনে মায়াবী নীল আলো উইন্ডোজ লোড করেই ব্যঙ্গ করে লেখে ‘ওয়েলকাম’।
আমাদের অফিস অলসো ফিল্স ফর আস! টেকনিকাল নলেজ বাড়াতে চাও? যাও না, লাইব্রেরি গিয়ে পড়াশোনা করো। সময় কাটছে না? ফেসবুক করো। ইনডোর গেম খেলো। স্মোকিং জোনে গিয়ে যত খুশি সময় কাটাও। আড্ডা মারো। খাও, কফি পিয়ো। কেউ কিচ্ছু বলবে না। আমি না বেঞ্চ? কোম্পানির রিসোর্স পুল। আশায় আশায় বসে থাকি। ডাক আসবে কবে?
আসবে তো ডাক স্যর? সত্যি আসবে তো আমার প্রোজেক্ট? পরিচিত কেউ যদি জিজ্ঞেস করে, অফিসে কাজের চাপ কী রকম, আমি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকি। বুকস্টোরগুলোতে সেল্ফ-ম্যানেজমেন্টের তাকগুলো এড়িয়ে যাই। ওখানে বইয়ের নাম হয় ‘হাউ টু ম্যানেজ ইয়োর ওয়ার্ক স্ট্রেস’। আমার লজ্জা লাগে। কাজ চাই কাজ। আমার না ব্লু কলার জব? পনেরো তলা অফিস। এক্সপ্রেস লিফ্ট। খবরের কাগজে বিজনেসের পাতাটাতা কোনও দিনই নেড়েচেড়ে দেখতাম না। কাতারে তেলের দাম বাড়লে পঞ্জাবে কর্নফ্লেক্স প্রোডাকশনে কী ইমপ্যাক্ট হবে, বুঝতে বয়ে গেছে। কিন্তু ইদানীং দেখি। না, আন্তর্জাতিক অর্থনীতির তত্ত্বটত্ব বুঝি না। কিন্তু টাকার দাম পড়লে আমার ভেতরে আনন্দ হয়। ডলার আরও প্রেশাস হোক। টাকা পড়ুক। আরও পড়ুক। আমরা আরও চিপ লেবার হই। তবেই না আরও বেশি করে কাজ পাঠাবে আমেরিকা।
ডাক আসবে তো আমার? খবরের কাগজের ফ্রন্টপেজগুলো ডাক দিয়ে যায় কোন সকালে। ফ্ল্যাট ফর্টি পার্সেন্ট অফ। পাঁচ হাজার টাকার অ্যাপারেল কিনলেই সাড়ে সাতশো টাকার গিফ্ট ভাউচার। ডাকে ফোর নাইট থ্রি ডেজ পাট্টায়া উইথ ওয়ান নাইট স্টে ইন লাক্সারি ক্রুজ। দ্যাখো রাজারহাট সেক্টর ফাইভ। দ্যাখো স্কাইস্ক্র্যাপারের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ওই।
কালীমাকে ডেকেছিলাম ক্যাম্পাসিং-এর সময়। ওখন ওবা মাকে ডাকি। ওবামা, তুমি আমার বাবা-মা, একটা প্রোজেক্ট দাও না হুজুর! |