সদ্য এম এসসি শেষ হয়েছে। সাইকোলজির ছাত্র অনুপম। ক’দিনের জন্য দুর্গাপুরে দিদির বাড়িতে বেড়াতে এসে এক থমথমে পরিবেশের সম্মুখীন হল সে। ভাগনি মৌমিতার ফোলা গাল, আনত মুখ। দিদির রাগত চোখ, শক্ত চোয়াল। কারণ জানতে চাইলে ফোঁস করে শ্বাস ফেলল দিদি, ‘ছ’মাসও হয়নি নতুন স্কুলে ক্লাস ফাইভে ভর্তি হয়েছে তোর ভাগনি। এখন বলছে এই স্কুল নাকি ওর ভাল লাগছে না। বন্ধুদের বেশির ভাগই নাকি অসভ্য আর পাজি! ইদানীং নানা ছুতোয় স্কুল কামাইও শুরু করেছে। আজও শত বুঝিয়েও স্কুলে পাঠাতে পারলাম না।
এ বার তুই দেখ মাথা থেকে ওর পোকাটাকে তাড়াতে পারিস কি না। আমি বাপু আর পারছি না!’
কথাটা বলে দিদি চলে গেলে অনুপম ভাগনির পিঠে হাত রেখে নরম গলায় বলল, ‘শুনেছি তোদের স্কুলের মতো ভাল স্কুল এই তল্লাটে নাকি আর দু’টি নেই। সুন্দর বিল্ডিং, দারুণ ল্যাবরেটরি, দিদিমণিরা খুব কেয়ারফুল, প্রত্যেক বছর বোর্ডে কেউ না কেউ র্যাঙ্ক করে। সেই স্কুলে তুই কেন যেতে চাস না রে মৌ! ব্যাপারটা কী?’
একমাত্র মামাটির প্রচণ্ড ভক্ত মৌ। মামার কথায় তাই মুখ না তুলে সে পারল না। ছলছলে চোখে বলল, ‘স্কুল ভাল হলেও বন্ধুরা কেউ ভাল নয়! আড়ালে সবাই আমার নিন্দা করে।’
‘তোদের সেকশনে ছাত্রী ক’জন?’
‘বাহান্ন জন।’
‘সবাই কি তোর নিন্দা করে?’
‘সবাই নয়, যাদের সঙ্গে আমি বন্ধুত্ব পাতাতে যাই, তারাই বলে!’
‘ওদের বক্তব্য কী?’
‘কেউ বলে আমি দেমাকি, কেউ বলে হিংসুটে। কারও অভিযোগ আমি রামকিপটে, কেউ বলে গুলবাজ!’
‘তোর কী মনে হয়? ওরা যা বলে তুই তেমনটাই?’
‘একেবারেই না। দুঃখটা তো সেখানেই মামা। টিফিনে যারা টিফিন চেয়ে খায়, স্কুলে অ্যাবসেন্ট থাকলে ম্যাম কী টাস্ক দিয়েছে, সেটা দেখার জন্য যারা আমার খাতা হাতড়ায়, তারাই আড়ালে আমার পিণ্ডি চটকায়!’
‘তা আড়ালে বলা কথা তোর কানে আসে কী করে? কে তোকে বলে?’ |
‘সীমা, সীমা বলে। ক্লাসে ও-ই ভাল বন্ধু। বাকি সব ক’টাই পাজি, নচ্ছার! আমি তাই সীমা ছাড়া আজকাল আর কারও সঙ্গে কথা বলি না।’ ‘সীমা বলল আর তুই বিশ্বাস করলি! যারা তোকে হিংসুটে, কিপটে বলে, তাদের সঙ্গে সরাসরি তো কথা বলতে পারতিস। বলতে পারতিস, কী রে, কী দেখে আমাকে হিংসুটে আখ্যা দিলি? কী জন্যেই বা বললি কিপটে?’ ‘ওরে বাবা, তা হলে সীমা আমার সঙ্গে আড়িই করে দেবে! সীমা বলেছে, কথাগুলো সীমাকে ওরা বিশ্বাস করে বলেছে। এখন এ নিয়ে আমি যদি জল ঘোলা করতে যাই, ওকে ওরা বিশ্বাসঘাতক বলবে। সুতরাং ওই নিয়ে কোনও কথাই বলা যাবে না!’
যেহেতু অনুপম সাইকোলজির ছাত্র, তাই মানুষের মনের নানা অসংগতির খবরাখবর তার নখদর্পণে। মনে মনে খানিকক্ষণ সে সব নিয়ে নাড়াচাড়া করে বলল, ‘তুই তো গোঁসা করে সমালোচক বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করলি। কিন্তু সীমা কি ওদের সঙ্গে কথা বলে?’ ‘হ্যাঁ, বলে তো।’ ‘আচ্ছা তোর সমালোচকদের কেউ কি আশেপাশে থাকে? ইয়ে, মানে তাদের কারও বাড়ি কি ধারে কাছেই?’ ‘হ্যাঁ, স্বাতী তো পাশের পাড়া অমরাবতীতেই থাকে। আর প্রতিমা থাকে উত্তরায়ণে।’
কথা শেষ করেই মৌ বলল, ‘এ সব জানতে চাইছ কেন! কী ব্যাপার, মামা?’
অনুপমের ঠোঁটে রহস্যময় হাসি, ‘না, তেমন কিছু নয়। মনে মনে একটা হিসাব কষছি। দেখি কাল হিসাবটা মেলাতে পারি কি না!’
পর দিন সকালে টিফিন করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ঘণ্টা দুয়েক বাদে ফিরে এল অনুপম। ভাগনিকে একটা ক্যাডবেরি দিয়ে বলল, ‘কাল স্কুলে গিয়ে স্বাতী, প্রতিমা, পম্পা, শম্পাদের সঙ্গে আবার কথা বলবি, ভাব জমাবি।’
ভুরু কোঁচকাল মৌ, ‘অসম্ভব, আমি পারব না। এত কাণ্ডের পরেও ওদের সঙ্গে ভাব জমাতে গেলে সীমা রাগ করবে। ও বলেছে, যারা আমার এত নিন্দামন্দ করে তাদের সঙ্গে কিছুতেই আমি যেন না মিশি!’
অনুপম গম্ভীর হয়ে গেল, ‘ওই সীমাই তো যত নষ্টের গোড়া! ও-ই তোর মাথাটা খেয়েছে! স্বাতী, প্রতিমারা কেউ তোকে হিংসুটে, দেমাকি উপমায় ভূষিত করেনি। সবটাই ওর বানানো! ক্লাসে বন্ধুদের সঙ্গে তোর সম্পর্ক যাতে নষ্ট হয়ে যায় সেই জন্যই এ সব করেছে সীমা। ও চায় না ও ছাড়া আর কেউ তোর সঙ্গে বন্ধুত্ব করুক!’
ভাইয়ের সব কথা শুনে তার চক্ষু চড়কগাছ! অনুপম থামতেই চোখ বড় বড় করে দিদি বলল, ‘ওইটুকু পুঁচকে একটা মেয়ের পেটে এমন প্যাঁচালো বুদ্ধি! আমি তো ভাবতেই পারছি না!’
অনুপম হাসল একটু, ‘মেয়েটা নিজেই হয়তো জানে না, কেন এমন করছে। মৌকে ও ভালবাসে। কিন্তু মনের জটিলতার জন্য সেই ভালবাসার ভাগ কাউকে ও দিতে চায় না! আমি বাইরে বেরিয়েছিলাম স্বাতী আর প্রতিমার সঙ্গে কথা বলব বলে। ওদের সঙ্গে কথা বলবার পর সব জলবৎ তরলং হয়ে গেল। স্বাতীর মুখেই শুনলাম, এক বার স্বাতী টিফিনের সময় মৌয়ের সঙ্গে নাকি জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছিল। হঠাৎ কোথা থেকে সীমা এসে হাজির। স্বাতীকে ও এক কোণে টেনে নিয়ে গিয়ে বলেছিল, মৌয়ের সঙ্গে এত গল্প করার কী আছে রে! ও যে আড়ালে হামেশাই তোকে ‘মুটকি’ বলে সেটা কি তুই জানিস?’
মামার কথায় হাঁ হয়ে গেল মৌ, ‘এমা, ছি ছি! সীমা কী করে এ কথা বলতে পারল! বন্ধুদের সম্পর্কে এমন বাজে মন্তব্য কখনও আমি করি না।’
আমি জানি তুই করিস না। ভাগনির মাথায় হাত রাখল অনুপম, ‘এক জনের জন্য বাকি পঞ্চাশ জনের সঙ্গে বন্ধুত্ব নষ্ট করাটা কোনও কাজের কথা নয় মৌ।
এ বার থেকে সীমার কোনও কথাতেই কান দিবি না। আমি শিগ্গির ওর মা-বাবার সঙ্গে কথা বলব। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সীমার কাউন্সেলিং শুরু করা দরকার। নইলে আখেরে ওকে নিয়ে সমস্যা আছে!’ |