প্রবন্ধ ২...
সমাজের অভাব শাস্তি দিয়ে মিটবে?
মেয়েদের উপর অত্যাচারের ঘটনাগুলো এখন একেবারে আক্ষরিক অর্থে দৈনন্দিন। আলোচনারও কোনও শেষ নেই। সচেতনতা ভাল। বিশেষ করে পুলিশ প্রশাসন এবং রাজনীতিকদের ওপর কিছুটা চাপ পড়ছে, সেটা সুলক্ষণ। কিন্তু সমস্যার স্থায়ী সুরাহার পথে একটুও এগিয়েছি কি?
অপরাধের প্রতিকারের পথ হিসেবে কঠিন, আরও কঠিন শাস্তির বিধান দিচ্ছেন অনেকে। এখন প্রায় যে কোনও ধর্ষণের পরে ফাঁসির দাবি নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। চটজলদি ‘বিচার’-এর দাবিও জোরদার। পশ্চিমবঙ্গের মাননীয় রাজ্যপালও সম্প্রতি ধর্ষকদের ‘পেটানো’র পরামর্শ দিয়েছেন। কড়া শাস্তি, তৎক্ষণাৎ শাস্তি দিলেই অপরাধীরা নিরস্ত হবে, এই ধারণাটা খুবই প্রচলিত। আইন অনুসারে কঠোর শাস্তি নিশ্চয়ই দেওয়া দরকার। এ দেশে বিচার এবং শাস্তির প্রক্রিয়া যে সচরাচর বহু ত্রুটিতে পূর্ণ, সে কথাও অনস্বীকার্য। কিন্তু বড় অপরাধের কঠোর শাস্তি হলেই অপরাধ কমবে, এই ধারণা মেনে নেওয়া কঠিন।
এখানে একটা বিষয় খেয়াল করা জরুরি। যে অপরাধগুলি সবচেয়ে ভয়ানক, যেমন ধর্ষণ, ধর্ষণ করে খুন বা পুড়িয়ে মারা, সেগুলি কোনও অপরাধীর প্রথম অপরাধ হওয়া কঠিন। পকেটমারিতে পোক্ত না হয়ে কেউ কি ডাকাতি করে? তাই, পুলিশের রেকর্ডে থাক বা না থাক, এটা নিশ্চিত করেই বলা যায় যে, অপরাধীদের একটা বড় অংশ বড় অপরাধের হিসাব ধরলে সংখ্যাটা কোনও অংশেই চল্লিশ শতাংশের কম নয় মহিলাদের বিরুদ্ধে একাধিক অপরাধ করে। এই একাধিক অপরাধের ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, বড় অপরাধের ঘটনা অনেক কম ঘটত, যদি এই সব অপরাধী ‘একাধিক অপরাধ’ করে পার পেয়ে না যেত।
এই সত্য মাথায় রেখে শাস্তি ও অপরাধের সম্পর্কটা বিচার করা যেতে পারে। খবরের কাগজে আর টেলিভিশনের পর্দায় ব্রেকিং নিউজের মিছিল দেখে আমরা মনে করতে পারি, এই সব খবর এবং অপরাধীদের কঠোর শাস্তির দাবি যত বেশি প্রচারিত হবে, অপরাধীরা তত ভয় পাবে। কিন্তু অপরাধ যারা করে তাদের অভিজ্ঞতা ভিন্ন। তারা নিজেদের চার পাশে স্পষ্টতই দেখছে, কী ভাবে অজস্র ঘটনা ঘটে চলেছে, তার খবর বাইরে আসছে না, এলেও অপরাধী ধরা পড়ছে না, ধরা পড়লেও নানা ভাবে ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে, কোনও শাস্তিও হচ্ছে না। তাদের অভিজ্ঞতা তাদের জানিয়ে দেয় যে, মেয়েদের ওপর অত্যাচার করে কিছু না হওয়াটাই দস্তুর, অন্তত যতক্ষণ না একটা ভয়ঙ্কর কিছু ঘটছে। কয়েকটা খবর দেখে ভয় পেয়ে এই মুহূর্তের সহজলভ্য ফ্রি মজা হাতছাড়া করতে যাবে কোন উজবুক?
দ্রুত বিচার ও শাস্তি নিশ্চয়ই জরুরি। কিন্তু জরুরি আর যথেষ্ট এক নয়। অপরাধ যেখানে, যখন তৈরি হচ্ছে, সেখানে, সেই সূতিকাগারে তাকে দমন করতে না পারলে শুধু কিছু ‘হাই প্রোফাইল’ অপরাধের ‘দৃষ্টান্তমূলক’ শাস্তি দিয়ে সমস্যার সমাধানের পথে এগনো যাবে না। এখানে প্রশাসনের পাশাপাশি রাজনৈতিক দল ও সমাজের প্রভাবশালী অংশের একটা বড় ভূমিকা আছে। অপরাধ ও অপরাধী তৈরি হওয়ার, বেড়ে ওঠার অনেক কারণ আছে। কারণগুলো অজানা নয়। কিন্তু যতক্ষণ না আমরা সরাসরি সেই অপরাধের দ্বারা আক্রান্ত না হই, ততক্ষণ সেই সব কারণগুলো নিয়ে মাথা ঘামাই না। এর মাসুল শেষ অবধি গুনতেই হয়। তাই প্রশ্ন উঠবেই, ধর্ষকদের শাস্তির দাবি উঠবে, পুলিশের অন্যায় বা অপদার্থতার প্রতিবাদ হবে, ধর্ষিতা মেয়েটির জন্য মোমবাতি পুড়বে, টেলিভিশনের পর্দায় তুফান উঠবে, আর যে সমাজব্যবস্থা মেয়েদের উপর অত্যাচারকে লালন করছে, সেই অত্যাচারের বীজ বুনছে, তাকে পালটানোর কোনও চেষ্টা হবে না?
একটা কথা আজকাল খুব বেশি মনে হয়। এখন যাঁদের বয়স চল্লিশ বা তার বেশি, তাঁদের বেশির ভাগেরই ছোটবেলায় একটা পাড়া ছিল। বিভিন্ন আর্থিক ও সামাজিক গোত্রের মানুষের মধ্যে মেলামেশা ছিল, নানান ধরনের সামাজিক আদানপ্রদান ছিল, এমনকী বন্ধুত্ব ছিল। পাড়ার ফুটবল মাঠে পাঁচতলা বাড়ির ছেলেটির পাস থেকে গোল করে হিরো হত বস্তিবাসী তুখড় সেন্টার ফরওয়ার্ড। তাতে যেমন একে অন্যের ভাল-মন্দ বোঝার সুযোগ ছিল, তেমনই এক ধরনের সামাজিক প্রতিষেধকও কাজ করত। এবং অনেক রকমের অপরাধের সম্ভাবনা শুরুতেই ধরা পড়ত, তার একটা প্রাথমিক প্রতিকারের চেষ্টা হত, অনেক ক্ষেত্রেই সেই চেষ্টা ফলও দিত, অপরাধ সম্পূর্ণ এড়ানো না যাক, তাকে একটা সীমার মধ্যে বেঁধে রাখা যেত। সেই পাড়া-ভাবনা এখন প্রায় সম্পূর্ণত ইতিহাস হয়ে গেছে। এখন সমাজের বিভিন্ন বর্গের মানুষ কেবল নিজেদের মতো লোকের সঙ্গেই মেলামেশা করে। পাশাপাশি, কিন্তু একে অন্যের থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন সামাজিক অস্তিত্বের মধ্য দিয়ে বড় হচ্ছে
উচ্চ ও মধ্যবিত্ত এবং বস্তিবাসী ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। তাদের মধ্যে কোনও স্বাভাবিক যোগাযোগই নেই। আছে এক বিরাট ঔদাসীন্য, সন্দেহ, অনেকখানি অপছন্দ, ঘৃণাও। এই সমাজে অপরাধপ্রবণতা বাড়তে বাধ্য, কারণ প্রাথমিক পর্যায়ে তার লক্ষণগুলি বুঝে সেগুলির একটা মানবিক, কার্যকর চিকিৎসার কোনও অবকাশই আর নেই। তার সঙ্গে যোগ করুন রাজনীতি এবং অর্থনীতির উৎকট চেহারা ও চরিত্র।
কেবল শাস্তি চাই রব তুলে এই সমাজের স্বাস্থ্য ফেরানো যাবে?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.