প্রবন্ধ ১...
কথার ছলে
রেন্দ্র মোদী কলকাতায় এসে খানিক বাংলায় বক্তৃতা দিলেন। আমরা অনেকেই তা ইউটিউবে ‘জীবন্ত’ শুনলাম। বোঝাই যায়, তাঁর উদ্দেশ্য ‘আমি তোমাদের লোক’ বলে নিজেকে বিশেষ ভাবে প্রমাণ করা। কাগজ দেখে বিচিত্র উচ্চারণে ও নানা বাংলা শব্দের পর ভুল জায়গায় থেমে শ্রীমোদী তাঁর ‘বাংলা ভাষণ’ শেষ করলেন। তা হোক, বাংলা তো! নিজের ভাষা ‘না-বাঙালির’ মুখে শুনলে এমনিতেই বঙ্গভাষীর আহ্লাদের সীমা থাকে না। আর এ তো স্বয়ং নরেন্দ্র মোদী! তা ছাড়া ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ও শ্রীমোদী পশ্চিমবঙ্গবাসীর জন্য ‘বানানো’ বক্তব্যে লাগিয়ে দিয়েছেন। ‘বিশাল জনসমুদ্র দেখে’ নাকি তাঁর ‘হৃদয় ও মন আনন্দে বলতে চায়’ এই ভালবাসার কথা। সুতরাং মোদীর বাংলা বলায় কেউ যদি অভিভূত হন, দোষ দেওয়া চলে কি! তা ছাড়া, এটাই তো ‘আধুনিক’ রাজনীতির কৌশল। যার সঙ্গে কথা বলছ, যাকে উদ্দেশ করে কথা বলছ, পারলে তার ভাষায় কিছুটা বল। রাজনীতির অনেক কারবারিই ভারতবর্ষের মতো বহুভাষী গণতন্ত্রে এই কৌশল কাজে লাগান। জনগণের মাতৃভাষা বলতে পারলে জনমানসে খানিক বিশ্বাস ‘উৎপাদন’ করা যায়।
মনে পড়ছে গাঁধীজির কথা। জননেতা হিসেবে নিজেকে ক্রমশই গড়ে তুলেছিলেন তিনি, আর সেই গড়ে তোলার সময়, জীবনের বিভিন্ন পর্বে এই নানা ভাষার বিষয়টি বিশেষ ভাবে খেয়াল রেখেছিলেন। শুধু ভারতে নয়, দেশের বাইরে অভিবাসী ভারতীয়রাও তাঁদের ভিন্ন ভিন্ন মাতৃভাষা সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন। ‘ইন্ডিয়ান ওপিনিয়ন’ সাময়িক পত্রটির সঙ্গে লেখক ও পরিকল্পক হিসেবে গাঁধী গভীর ভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি স্থির করলেন, কাগজটিতে প্রথমে ইংরাজি ও গুজরাতি, পরে তামিল ও মরাঠি ভাষায় লেখা থাকবে।
গাঁধীবাদী নির্মলকুমার বসু তাঁর লেখায় জানিয়েছিলেন ভাষা-সংবেদী গাঁধীর বৃত্তান্ত। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের কথা। জননেতা হিসেবে গাঁধী তখন সুপ্রতিষ্ঠিত। তাঁর দরবারে লোকজনের আনাগোনা লেগেই আছে। জননেতার সঙ্গে জনগণের যোগাযোগের বিধিব্যবস্থা তৈরি করা চাই। সেক্রেটারি প্যারেলাল এই জনসংযোগের বিষয়টি দেখাশোনা করেন। ওয়ার্ধায় গাঁধী আশ্রমে প্যারেলালের ঘরের পাশে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। সিঁড়ির পাশে একটা মাঝারি গোছের কালো ব্ল্যাকবোর্ড। গাঁধীজি সারা দিনে কখন কার-কার সঙ্গে দেখা করবেন, তার তালিকা খড়ি দিয়ে লেখা। দেখা করবেন যাঁরা, তাঁদের নানা জনের নানা ভাষা। গাঁধী চেষ্টা করেন সেই নানা ভাষাতে সংযোগ সাধন করতে, পরামর্শ দিতে, কথা শুনতে। তাঁর যতটা সাধ্য ততটাই করেন। মহাত্মার সঙ্গে বাক্যালাপ চলছে, রয়েছেন নির্মলকুমার বসু ও সীমান্ত নেতা আবদুল গফফর খান। ইংরিজিতেই কথা হচ্ছিল, সে ইংরেজি শক্ত নয়, কিন্তু খান সাহেব বললেন, তাঁর পক্ষে সমস্ত কথা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে। গাঁধী নির্মলকুমারকে জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি উর্দু বোঝেন কি না! মোটামুটি বোঝেন জেনে গাঁধী সরল স্পষ্ট ইংরেজির পরিবর্তে ‘অত্যন্ত সরল হিন্দুস্থানি বা উর্দু’ ব্যবহার করতে লাগলেন। এই নানা ভাষার জ্ঞান গাঁধী দীর্ঘ দিনের নিয়মিত অনুশীলনের মধ্য দিয়ে অর্জন করেছিলেন, পাতায় লিখে দেওয়া চার-পাঁচটা বাক্য দেখে খামচা মেরে কিছু বলা তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না। তিনি জানতেন জননেতা হওয়া একটা পদ্ধতি, একটা শিক্ষা, কঠিন সাধনার মাধ্যমে, অনুশীলনের পথে ক্রমে তা অর্জন করতে হয়। সে পথে ভুলত্রুটি হয়, তা সংশোধনসাপেক্ষ। আর, পূর্ণসিদ্ধি কখনওই আসে না। প্রতি মুহূর্তে চলতে হয়। চলাটা সত্য। শিখতে শিখতে চলা।
হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক স্বাধীনতার আগে যখন তলানিতে ঠেকেছিল, তখন গাঁধী পথে নেমেছিলেন। নোয়াখালির পথে তিনি হিন্দু মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে গিয়েছেন, প্রার্থনা করেছেন, আবেদন জানিয়েছেন দাঙ্গা বন্ধ করার জন্য। নির্মলকুমার বসু এই ছেচল্লিশেও গাঁধীর সহযাত্রী। ১১.১২.৪৬, বুধবার। নির্মলকুমার তাঁর ডায়েরিতে জানিয়েছেন গাঁধী হিন্দি-বাংলা সহায়িকা কিনে নিজে নিজে বাংলা শেখার চেষ্টা করছেন। রপ্ত করতে চাইছেন বাংলা বর্ণমালা। নির্মলকুমারকে বলছেন তাঁর সঙ্গে হিন্দি বা ইংরেজিতে নয়, বাংলায় কথা চালাতে। এই যে জীবনের এই পর্বে নতুন করে একটা ভারতীয় ভাষা শিখতে চাইছেন গাঁধীজি, এর মধ্যে কোনও নাটকীয়তা নেই, কোনও সস্তা চমক নেই। যাঁদের তিনি দাঙ্গা থামাতে বলছেন, পূর্বদেশের সেই মানুষের ভাষা তো বাংলা। সে ভাষায় নিজেকে প্রকাশ করতে পারলে তাঁর আবেদন হয়তো নামঞ্জুর হবে না। আর এ তো তিনি করেই থাকেন নানা জনের ভাষা শিখতে চান। ‘ইন্ডিয়ান ওপিনিয়ন’ পর্বেই হোক কিংবা ’৩৪-এ ওয়ার্ধায় অথবা ’৪৬-এ বঙ্গদেশে, নানা জনের ভাষা বলার ও শেখার মন গাঁধী হারিয়ে ফেলেন না। ভাষা মানে তাঁর কাছে কেবল কতকগুলো শব্দ নয়। যে মানুষগুলো সে ভাষা ব্যবহার করেন ভেতর থেকে তাঁদের বুঝতে চান তিনি। সহযাত্রী গাঁধী, পথে নেমেছেন, ধুলো মেখেছেন। গাঁধীর রাজনৈতিক মত সবাই না মানতে পারেন, সত্যের সঙ্গে তাঁর আত্মপরীক্ষার সম্পর্ক অনেকের না-পছন্দ হতে পারে, কিন্তু জীবনের নানা পর্বে নানা জনকে তিনি যে ভাবে নানা ভাষায় বুঝতে চেয়েছেন, তার গুরুত্ব অস্বীকার করার উপায় নেই। তিনি ব্যর্থ না সফল, সে প্রশ্ন অন্য। কিন্তু তাঁর এই প্রয়াস? সে তো ফেলে দেওয়ার নয়।
ওয়ার্ধা, নোয়াখালি অতীত। কলকাতার ব্রিগেড বর্তমান। এ-কালের নরেন্দ্র মোদীরা ভারতের নানা গোষ্ঠীর ভাষা ভেতর থেকে শেখার জন্য খুব একটা তৎপর বলে মনে হয় না। ভোটের স্বার্থে প্রয়োজন মতো সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা ওপর ওপর রপ্ত করেন। তাঁদের কাছে নেতৃত্ব মানে মঞ্চ থেকে কথা বলা। সামনে ‘জন সমুদ্র’, ওপরের মঞ্চ থেকে ভাষণ দিয়ে দ্রুতগামী আকাশযান চেপে তাঁরা সফর শেষ করেন। এই সফরে কাগজ দেখে স্থানীয় ভাষায় কিছু বুলি দিতে পারলে করতালি বেশি জোটে, ভোটবাক্সে তার প্রতিফলন পড়তেও পারে।
আর একটা কথা। মোদীর বাংলা ভাষণে কেবল দুর্গাপুজো, রসগোল্লা, ঢাক, শঙ্খ বাঙালি জীবনের এই সাংস্কৃতিক স্টিরিওটাইপগুলির উল্লেখই ছিল না। বাঙালির ‘প্রবুদ্ধ মানসিকতা’ ও ‘মনোহর সাহিত্য’, এই দুই শব্দবন্ধও ছিল। এই সংস্কৃতায়িত বাংলা বুলি কানে ঢুকতে মনে হল, হিন্দুয়ানির যে বিশেষ রূপটিকে ভারত সংস্কৃতির ‘একমাত্র’ চেহারা বলে নির্দিষ্ট করতে চান সঙ্ঘ-সেবকেরা তার সঙ্গে যেন এই কৃত্রিম সংস্কৃতায়িত শব্দবন্ধের কোথাও একটা যোগ আছে।

বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.