জীবন যদি কেতা-পূর্ণ হইতে পারে, মৃত্যু তাহা হইবে না কেন? নিজ জীবনের মহার্ঘ ক্ষণগুলি মানুষ মৌলিকতার ছাপ দ্বারা বিশিষ্ট করিয়া রাখিতে চাহে, কখনও জন্মদিনে ভাড়া করিয়া আনে চিত্রতারকা, কখনও বিবাহ-অনুষ্ঠান সারে সমুদ্রের তলদেশে। জন্ম ও বিবাহের ন্যায়, মৃত্যুও তো তাহার নিতান্ত নিজস্ব এক মোক্ষম ঘটনা। উহাতে স্বকীয় সিলমোহর লাগাইবার ভাবনা নিতান্ত স্বাভাবিক। সম্প্রতি ওহায়ো-র এক ভদ্রলোককে তাঁহার ইচ্ছা অনুযায়ী সমাধিস্থ করা হইল তাঁহার প্রিয় মোটরসাইকেলের উপর উপবিষ্ট অবস্থায়। আবার পুয়ের্তো রিকো-র এক বক্সার খুন হইবার পর তাঁহার পরিবার এমন ব্যবস্থা করিলেন, মৃতদেহের প্রতি শ্রদ্ধা জানাইতে আসিয়া সকলে দেখিল, তিনি এক বক্সিং রিং-এর প্রান্তে হেলান দিয়া দাঁড়াইয়া, পরনে বক্সিং-এর পোশাক, মুষ্টিবদ্ধ হস্তে দস্তানা, চক্ষে সানগ্লাস। এই প্রকার ইচ্ছা ও তাহার বাস্তবায়ন ক্রমে জনপ্রিয় হইতেছে। বিশ্বে বহু মানুষ তাঁহার শবাধার নিজ ফরমায়েশ অনুযায়ী নির্মাণ করাইয়া রাখেন, কফিনের আকার প্রায়ই হয় পানীয়ের বোতল বা জুতা, গ্রন্থ, উড়োজাহাজের ন্যায়। পপকর্নের ঠোঙার আদলেও কফিন তৈয়ারি হইয়াছে। মৃত্যুকে মোকাবিলা করিবার কালে, তাহার গাম্ভীর্যের স্ফীত গলগণ্ডটি সামান্য ফাঁসাইয়া অট্টহাস্য করিয়া উঠিবার সাধ্য মানুষ ব্যতীত কাহারই বা হইবে! মেক্সিকোয় ‘মৃতের দিবস’ উপলক্ষে রসিকতার বন্যা ডাকিয়া যায়, সমাধির উপর মাদুর বিছাইয়া আত্মীয়গণ হইহই করিয়া পানভোজন করেন, মিছিল বাহির হয়: অংশীরা ভূতের মুখোশ পরিয়া, কাঠির প্রান্তে প্রেতের মুণ্ড-ছাঁচ নাচাইয়া উল্লাসে নগর প্রদক্ষিণ করেন। মৃত ব্যক্তিদিগের মুদ্রাদোষ লইয়া ছড়া ও গান আবৃত্ত ও গীত হয়। রোমানিয়ার এক গ্রামে প্রতিটি সমাধির উপর অঙ্কিত হয় মৃত ব্যক্তির চিত্র, নিম্নে লিখিত থাকে একটি ছড়া, মানুষটির গুণপনা বর্ণনের সহিত ছড়াটি তাহার ত্রুটিগুলিকে ঠুকিতেও ছাড়ে না।
সন্দেহ নাই, প্রতিটি মানুষের জন্মের ক্ষণেই জন্মিয়াছে তাহার মৃত্যু, যমজ ভ্রাতার ন্যায় সে চলিয়াছে অঙ্গ ঘেঁষিয়া, কিন্তু তাহা বলিয়া এই চূড়ান্ত অবসানকে সত্যই কি কৌতুক বা প্রসন্নতা দ্বারা অভিবাদন করিবার কারণ রহিয়াছে? ইহা অপেক্ষা গলা ছাড়িয়া কাঁদিলে নির্মম ঘটনাটির প্রতি একটি যথাযথ আপত্তি জানাইয়া রাখা যাইত না কি? রবীন্দ্রনাথ বলিয়াছিলেন, ‘বস্তুজগৎ যদি অটল কঠিন প্রাচীরে আমাদের রেখে দিত, এবং মৃত্যু যদি তার মধ্যে বাতায়ন খুলে না রেখে দিত, তা হলে আমরা যা আছে তারই দ্বারা সম্পূর্ণ বেষ্টিত হয়ে থাকতুম। এ ছাড়া আর যে কিছু হতে পারে তা আমরা কল্পনাও করতে পারতুম না।’ প্রশ্ন হইল, কল্পনা করিতে পারিবার দরকারটিই বা কী? যদি বস্তুজগৎ দ্বারা আমরা বেষ্টিত হইয়া থাকিতাম, অনন্তের অজানার অস্পষ্ট ধারণারাশি কাহারও হৃদয়ে না গজাইত, আর বিনিময়ে মৃত্যু কখনও আমাদের স্পর্শ না করিত, তাহা কোনও অংশে হীন বন্দোবস্ত হইত বলিয়া মনে হয় না। নশ্বর এই জীবনের অবসান হইবেই, ঠেকাইয়া রাখা যাইবে না, কিন্তু সেই কারণে মৃত্যুর প্রতি প্রবল মহিমা আরোপ করিয়া গদগদ হইয়া পড়িবার কারণ কী? মৃত্যু এমন এক মস্তান যাহার অত্যাচার দায়ে পড়িয়া মানিয়া লইতে হইতেছে। মনুষ্যের প্রকৃত আত্মমর্যাদা মস্তানটিকে মাল্যদান করিবার মধ্যে নাই, অতি কঠোর মুখ করিয়া তাহার ব্যবহারটির প্রতি তীব্র অপছন্দ জানাইবার মধ্যেই আছে। নিপীড়কের মুখের উপর বেপরোয়া ফাজিল হাসিয়া উঠিলে তাহা দুরন্ত নাটকীয় মুহূর্তের জন্ম দেয় বটে, কিন্তু উহাতে দৃশ্যটি লঘু ও তরল করিয়া ঘটনাটিকে এক প্রকার মান্যতা দেওয়া হয়। ‘মৃত্যু অবধারিত, তাই তাহারে লও সহজে’ উপদেশটির অন্তরালে, কৌতুক বা অভিনবত্ব বা মহান গভীর চিন্তা দ্বারা মৃত্যুকে রঞ্জিত করিতে চাহিবার অন্তরালে, প্রকৃত প্রস্তাবে রহিয়াছে মৃত্যুভয়ের করাল স্বরূপ হইতে পলাইবার প্রবণতা। উহা অপেক্ষা, ট্র্যাজেডিকে ট্র্যাজেডি বলিবার সিধে মনোভঙ্গি শ্রেয়। |