বিরোধীদের আশঙ্কামতোই ক্রস ভোটিং হল রাজ্যসভার ভোটে।
দলের বিরুদ্ধে গিয়ে শুক্রবার কংগ্রেসের দুই বিধায়ক, সুতির ইমানি বিশ্বাস এবং গাজোলের সুশীলচন্দ্র রায় তৃণমূলের প্রার্থীকে ভোট দিলেন। ফরওয়ার্ড ব্লকের সুনীল মণ্ডল, আরএসপি-র দশরথ তিরকে এবং অনন্তদেব অধিকারীও একই কাজ করেছেন। আপাতত এই 'বিক্ষুব্ধ' বিধায়কদের নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েছে বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেস, দুই শিবিরই!
রাজ্যসভার ভোটে দলীয় কোনও নির্দেশ বা হুইপ কার্যকর হয় না। ফলে দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোট দিলে কোনও বিধায়কের সদস্যপদ খারিজের সংস্থান নেই। ওই বিধায়কেরা যদি এখন স্বেচ্ছায় অন্য দলে (তৃণমূলে) যোগ দেন, তবেই দলত্যাগ-বিরোধী আইনে স্পিকারের কাছে তাঁদের সদস্যপদ খারিজের জন্য আবেদন করতে পারবে পুরনো দলগুলি। কিন্তু কোনও দল আগেভাগেই তাঁদের বহিষ্কার করে দিলে বিক্ষুব্ধরা তৃণমূলে যোগ দিয়ে নিজেদের বিধায়ক-পদ রক্ষা করে ফেলবেন। সেই কারণেই আগ বাড়িয়ে বহিষ্কারের পথে যেতে চাইছে না কোনও দলই। কিন্তু যতক্ষণ না ওই বিধায়কদের পদ খারিজ হচ্ছে, তত ক্ষণ তাঁদের নিয়ে অস্বস্তিও ভোগ করে যেতে হবে! এক কথায়, ক্রস ভোটিং করে নিজেদের দলকে শাঁখের করাতে ফেলে দিয়েছেন পাঁচ বিধায়ক! কংগ্রেস বিধায়ক আবু নাসের (লেবু) খান চৌধুরী অবশ্য বিস্তর জল্পনা সত্ত্বেও কংগ্রেস-সমর্থিত নির্দল প্রার্থীকেই ভোট দিয়েছেন। |
মুখরক্ষার তাগিদে এ দিনই কংগ্রেস এবং ফব তাদের 'বিক্ষুব্ধ' বিধায়কদের সাসপেন্ড করেছে। আরএসপি নেতৃত্ব এখনও কোনও সিদ্ধান্ত না নিলেও দলের মধ্যে দুই বিধায়ককে বহিষ্কারের দাবি উঠেছে। তবে আগেভাগেই 'বহিষ্কার ছাড়া পথ নেই' বলে মন্তব্য করে প্রশ্নের মুখে পড়েছেন দলের রাজ্য সম্পাদক ক্ষিতি গোস্বামী। নানা নাটকের মধ্যেও সিপিএম কিন্তু তাদের বিধায়কদের এককাট্টা রাখতে পেরেছে। ফলে নীতির প্রশ্নে মাঝেমধ্যেই সিপিএমকে বিঁধে আসা দুই বাম শরিক পড়েছে আরও বেকায়দায়! ফব-র সুনীলবাবু শিবির পাল্টালেও তাঁদের দুই বিধায়ক প্রলোভনের কথা দলকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। আরএসপি-র সেটুকু মুখ বাঁচানোরও উপায় নেই!
কংগ্রেসের দুই বিধায়ক ইমানি এবং সুশীলবাবু তৃণমূলকে ভোট দিয়ে এ দিন বলেছেন, "কংগ্রেসের নিজস্ব প্রার্থী নেই। কংগ্রেস-সিপিএম হাত মেলানোয় নির্দল প্রার্থীকে সমর্থন করিনি। তৃণমূলের প্রার্থীকেই ভোট দিয়েছি।" ওই দু'জনকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য দল থেকে সাসপেন্ড করার পরে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেন, "বিধানসভায় এই দুই বিধায়কের জায়গা আলাদা করার জন্য স্পিকারের কাছে আবেদন জানানো হবে।" দীর্ঘদিন ধরেই ওই দু'জনের বিরুদ্ধে দলবিরোধী কাজের অভিযোগ আসছিল বলে প্রদীপবাবু জানান। তাঁর কথায়, "দলীয় স্তরে তদন্ত চলছিলই। রাজ্যসভার ভোটে এঁরা তৃণমূলে ভোট দেওয়ায় দল-বিরোধিতা আরও স্পষ্ট হল।"
মুর্শিদাবাদের প্রাক্তন কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর প্রতিক্রিয়া, "ইমানি তাঁর নিজের নামের সঙ্গেই ইমান রাখলেন না! বিশ্বাসঘাতকতা করলেন! তিনি তো রাজনৈতিক ভিখারি। তাঁর উচিত বিধায়ক পদে ইস্তফা দিয়ে নতুন করে ভোটে দাঁড়িয়ে জনাদেশ নেওয়া।" অধীরের অভিযোগ, মালদহে ইমানির দেড়শো থেকে দু'শো কোটি টাকার ব্যবসা রয়েছে। সেই ব্যবসার সুবাদেই শাসক দলের নেতাদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে। ইমানির পাল্টা অভিযোগ, "সুতির বিধায়ক হিসেবে প্রাপ্য মর্যাদা আমাকে দেওয়া হচ্ছিল না। কংগ্রেস-সিপিএমের যৌথ প্রার্থীকে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। উনি রাজ্যসভায় জিতে কোন দলের হয়ে কথা বলবেন?" বৃহস্পতিবার রাতে টাকা দিয়ে বড়ঞার কংগ্রেস বিধায়ক প্রতিমা রজককেও তৃণমূল কিনতে চেয়েছিল বলে অধীরবাবুর অভিযোগ। তৃণমূল অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
আরএসপি-র দশরথবাবু ও অনন্তবাবু এবং ফব-র সুনীলবাবুও অর্থের টোপে তৃণমূলকে ভোট দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। প্রথম দু'জন উত্তরবঙ্গ-সহ সার্বিক উন্নয়নের জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলে যোগ দেওয়ার কথা বলেছেন। আর সুনীলবাবুর দাবি, সিপিএমের 'দাদাগিরি', নেতাই-সিদ্ধান্ত ইত্যাদি মানবেন না বলে এমন সিদ্ধান্ত। রাজ্যসভার ভোটের আগের দিন কেন 'দাদাগিরি'র কথা মনে পড়ল, সেই প্রশ্নের সদুত্তর অবশ্য দিতে চাননি গলসির বিধায়ক! সিপিএমের বর্ষীয়ান বিধায়ক আব্দুর রেজ্জাক মোল্লার মন্তব্য, "৩৪ বছরে আমরা অনেক ভেজাল মাল ঢুকিয়েছিলাম! এখন সে সব বেরোচ্ছে!"
তৃণমূলের সাসপেন্ড হওয়া বিধায়ক শিখা মিত্র ক্রস ভোটিং করে কংগ্রেস-সমর্থিত আহমেদ সৈয়দ মালিহাবাদিকে ভোট দিয়েছেন। তাঁর কথায়, "দল আমায় কোনও নির্দেশ দেয়নি। আমি নিজের পছন্দ ও বিবেক থেকে নির্দল প্রার্থীকে ভোট দিয়েছি।" শাসক দলের একাংশেরই অভিমত, রাজ্যসভার ভোট-প্রক্রিয়া বিধানসভার অধিবেশন বা কার্যবিবরণীর এক্তিয়ারে পড়ে না। ফলে স্পিকারের কাছে শিখার সদস্যপদ খারিজের আবেদন করে লাভ হবে না। তবে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় বলেন, "দলে আলোচনা করে শিখার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।"
গোটা ঘটনায় অধীর সরাসরি তৃণমূল নেত্রীকেই কটাক্ষ করেছেন। বলেছেন, "বেচাকেনার খেলা বাংলায় আগে ছিল না। গো-বলয়ে ছিল। তবে যে খেলা তিনি (মমতা) শুরু করেছেন, এতে তৃণমূলেরই মৃত্যু ঘনিয়ে আসবে!" লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় বলেন, "যাঁরা সুবিধা ভোগ করেন অথচ দলের নিয়ম নীতির তোয়াক্কা করেন না, তাঁদের আমি ঘৃণা করি!" |