|
|
|
|
বাম -কংগ্রেসের ঘর ভেঙে কিস্তিমাত করল তৃণমূল
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
টান টান রুদ্ধশ্বাস ম্যাচ। উইকেট পড়ল সব দলেরই। তার মধ্যেই 'ফটোফিনিশে' খেলা বের করে নিয়ে গেল তৃণমূল। শুধু নিজেদের শক্তির বিচারে চতুর্থ প্রার্থীকে জেতানো সম্ভব নয় জেনেও চার জনকেই ভোটে দাঁড় করিয়েছিলেন তৃণমূল নেতৃত্ব। শেষ পর্যন্ত বাম ও কংগ্রেসের ঘর ভেঙেই সব ক'জনকে জিতিয়ে আনলেন তাঁরা। তাঁদের দিক থেকেও একটি ভোট অবশ্য কংগ্রেস সমর্থিত নির্দল আহমেদ সৈয়দ মালিহাবাদির বাক্সে পড়ল। সেটি নিয়ে, বামেদের উদ্বৃত্ত এবং কংগ্রেসের সব ভোট যোগ করেও কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি তাঁর। সামান্য ব্যবধানে হেরে গেলেন তিনি। দিনের শেষে রাজনৈতিক দলগুলির হিসেব থেকে যা জানা গিয়েছে সেই অনুযায়ী, তৃণমূলের চতুর্থ প্রার্থী যদি একটি কম ভোট পেতেন এবং সেটি যদি মালিহাবাদির বাক্সে পড়ত, তা হলেই জিতে জেতেন তিনি!
এই ভোটের পরেই বাম ও কংগ্রেস শিবির একযোগে অভিযোগ করেছে, বিধায়কদের টাকার টোপ দিয়ে এবং ভয় দেখিয়ে অনৈতিক ভাবে জয় হাসিল করেছে শাসক দল। জয়ী সিপিএম প্রার্থী ঋতব্রতও জানিয়েছেন, গণতন্ত্রের ভূলুণ্ঠিত হওয়ার অভিযোগ তিনি রাজ্যসভায় তুলতে চান। যে অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা বলেছেন, "বাংলায় এ সব হয় না! তৃণমূল স্বচ্ছ দল। কংগ্রেস-সিপিএম এক হয়েছিল বলেই নীতিগত ভাবে ওঁদের অনেকে সমর্থন করতে পারেননি। যাঁরা তৃণমূলকে সমর্থন করেছেন, নিজেদের সিদ্ধান্তেই তাঁরা ভোট দিয়েছেন।" পাশাপাশি দলের চার জয়ী প্রার্থী চিত্রকর যোগেন চৌধুরী, অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তী, ব্যবসায়ী তথা বর্তমান সাংসদ কে ডি সিংহ এবং সাংবাদিক আহমেদ হাসান (ইমরান) সম্পর্কে মমতা বলেছেন, এঁরা সকলেই রাজ্যসভায় বাংলার উন্নয়নের পক্ষে কাজ করবেন।
|
বিজয়ী পাঁচ (বাঁ দিক থেকে) আহমেদ হাসান ইমরান, কে ডি সিংহ, মিঠুন চক্রবর্তী,
যোগেন চৌধুরী ও ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় (ডান দিকে)। —নিজস্ব চিত্র। |
রাজ্যসভার এ বারের ভোট নিয়ে নজিরবিহীন নাটকীয় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। তাদের তিন বিধায়ককে ভাঙিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে ভোটের আগের দিনই অভিযোগ করেছিল বামফ্রন্ট। একই অভিযোগ ছিল আর এক বিরোধী দল কংগ্রেসের তরফেও। ভোটের দিন দেখা গিয়েছে, শাসক তৃণমূলের প্রার্থীদের ভোট দিয়েছেন মোট পাঁচ জন বিরোধী বিধায়ক। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন বামেদের তিন বিধায়ক আরএসপি-র অনন্তদেব অধিকারী ও দশরথ তিরকে এবং ফরওয়ার্ড ব্লকের সুনীল মণ্ডল আছেন। আছেন কংগ্রেসের দুই বিধায়ক ইমানি বিশ্বাস ও সুশীল রায়ও। এ ছাড়া, সৌমিত্র খান ইতিমধ্যেই তৃণমূলে চলে গেলেও খাতায়-কলমে তিনি এখনও কংগ্রেসের বিধায়ক। তিনিও এ দিন ভোট দিয়েছেন তৃণমূলকে। কংগ্রেস বিধায়ক আবু নাসের খান চৌধুরীর ভোট কোন দিকে যাবে, তা নিয়েও সংশয় ছিল। বৃহস্পতিবার দিনভর নাটকের পরে রাতে তিনি জানান, দলের সমর্থিত প্রার্থীকেই ভোট দেবেন। কিন্তু শুক্রবার ব্যালট পেপারের পিছনে সই করে দিয়ে আসেন। তাতে প্রশ্ন ওঠে, এই ভোট বাতিল হয়ে যাবে কি না। শেষ পর্যন্ত অবশ্য তা গ্রাহ্যই হয়েছে। বাতিল হয়েছে দুই বিধায়কের ভোট। এর মধ্যে এক জন নির্দল বিধায়ক উইলসন চ্যাম্প্রামারি। অন্য জনের নাম এ দিন জানা যায়নি।
ভোটের অঙ্ক তাঁর অনুকূলে আসছে না বুঝে এ দিন ফল ঘোষণার আগেই মালিহাবাদি বলেছেন, "পশ্চিমবঙ্গে নতুন এক পরিবর্তন এসেছে। আয়ারাম-গয়ারামের নোংরা রাজনীতি শুরু হয়েছে! রাজনীতির পরিবেশটাই দূষিত হয়ে গিয়েছে! এ বারের ভোটে দাঁড়িয়ে এই শিক্ষাই পেলাম!" কংগ্রেস ও বাম শরিক ফব তাদের বিক্ষুব্ধ বিধায়কদের দল থেকে সাসপেন্ড করেছে। আরএসপি নেতৃত্ব এখনও তাঁদের দুই বিধায়কের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেননি।
ভোট গণনার পরে অবশ্য দেখা গিয়েছে, প্রথম ও দ্বিতীয় পছন্দের ভোটের নিরিখে খুব সামান্য ব্যবধানে হেরেছেন মালিহাবাদি। নিজেদের প্রার্থীর জয় নিশ্চিত করে বাড়তি ভোট দ্বিতীয় পছন্দের আকারে মালিহাবাদিকে দিয়েছিল বাম শিবির। কংগ্রেসের ৩৬ বিধায়কের প্রথম পছন্দের ভোটও তিনি পেয়েছিলেন। পেয়েছিলেন তৃণমূলের বিক্ষুব্ধ বিধায়ক শিখা মিত্রের ভোটও। অঙ্কের চুলচেরা হিসেব বলছে, বাম বা কংগ্রেস শিবিরের বিক্ষুব্ধ বিধায়কদের মধ্যে কোনও এক জন তৃণমূলকে না-দিয়ে মালিহাবাদিকে দিলে তিনিই জিততে পারতেন! ফল ঘোষণার পরেই তৃণমূলের বিরুদ্ধে অর্থের লোভ দিয়ে ভোট ভাঙিয়ে জেতার অভিযোগ এনেছে বিরোধীরা। ফল জানার পরে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছেন, "টাকা-পয়সার খেলা অনেক দিন ধরেই চলছে। বাজার সরকার ঘুরে বেড়াচ্ছে! এই ভোটে সেটা ফের প্রমাণিত!" আর প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যের অভিযোগ, "বাংলার মুখে চুন-কালি লেপে দিয়েছে তৃণমূল! আমরাও উত্তরের কিছু রাজ্যের মতো গরু-ছাগল কেনাবেচার রাজনীতিতে সামিল হয়ে গেলাম!"
লোকসভা ভোটের মাত্র কয়েক মাস আগে যখন বিধায়ক কেনাবেচার অভিযোগকে বিরোধীরা তৃণমূলের বিরুদ্ধে হাতিয়ার করতে চাইছে, তখনই শাসকদল পাল্টা অভিযোগ তুলল কংগ্রেস-সিপিএম সমঝোতার। তিন জয়ী প্রার্থী মিঠুন, যোগেন ও ইমরানকে (সেই সময় কে ডি ছিলেন না) পাশে নিয়ে বিধানসভার পোর্টিকোয় দাঁড়িয়ে এ দিন সন্ধ্যায় মমতা বলেছেন, "ওরা প্রকাশ্যেই অঙ্গীকার করেছিল, কংগ্রেস আর সিপিএম একসঙ্গে ভোট দেবে। আমি সংবাদমাধ্যমে দেখেছিলাম।
এখন আবার শুনছি, একটা পার্টি (বাম) ভয়ে সব ভোট নিজেদের প্রার্থীকেই দিয়েছে!"
তখনও ভোটের হিসেব হাতে আসেনি। তাই তৃণমূল শিবিরের ধারণা ছিল, বামেদের কোনও ভোট নির্দল প্রার্থী পাননি। তার ভিত্তিতে কংগ্রেসের পরিষদীয় দলনেতা মহম্মদ সোহরাব ও বিধায়ক মানস ভুঁইয়াও মুখ্যমন্ত্রীকে পাল্টা আক্রমণ করে বলেন, "একটা ভুল তত্ত্ব প্রচার করা হচ্ছে! বামেরা একটি ভোটও নির্দল প্রার্থীকে দেননি! এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে, কংগ্রেস-সিপিএম আঁতাঁতের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা!" |
জয়ী তৃণমূল প্রার্থীদের সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুক্রবার বিধানসভায় সুদীপ আচার্যের তোলা ছবি। |
একই সঙ্গে তাঁদের বক্তব্য ছিল, "হাতে ৩৮টা ভোট (বিক্ষুব্ধদের এ দিন শিবির বদলের আগে কংগ্রেসের বিধায়ক সংখ্যা) নিয়ে আমরা নিজেদের প্রার্থীকে জেতাতে পারতাম না। তাই নির্দল প্রার্থী মালিহাবাদি আমাদের কাছে সমর্থন চাওয়ায় তাঁকে ভোট দেব বলেছিলাম। অন্য কোন দল তাঁকে সমর্থন করবে, তা আমাদের দেখার বিষয় ছিল না।"
পরে অবশ্য বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র এবং সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রবীন দেব প্রথম ও দ্বিতীয় পছন্দের ভোটের হিসেব ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেন, নির্দল প্রার্থীকে প্রতিশ্রুতি মতোই উদ্বৃত্ত ভোট দেওয়া হয়েছে। সূর্যবাবুর কথায়, "মুখ্যমন্ত্রী অঙ্কটা না জেনেই বলে দিয়েছেন! মালিহাবাদির আমাদের কাছে উদ্বৃত্ত ভোট প্রাপ্য ছিল। আমরা তা-ই দিয়েছি। এর চেয়ে এক জনের ভোট বেশি দিতে গেলে আমাদের প্রার্থীকে জেতানো সমস্যা হতো।"
অঙ্কের বিশ্লেষণ যা-ই হোক, তৃণমূল নেতৃত্ব বিধায়ক কেনাবেচার অভিযোগ সামাল দিতে কংগ্রেস-বাম সমঝোতাকেই আপাতত পাল্টা নিশানা করছে। ঘনিষ্ঠমহলে তৃণমূল নেত্রীর বক্তব্য, এ দিনই অসমে রাজ্যসভার ভোটে এক জন নির্দল প্রার্থী ছিলেন। তিনি অন্যান্য দলের সঙ্গে বিজেপি-র সমর্থনও নিয়েছিলেন। তাই বিজেপি-র ছোঁয়া বাঁচানোর জন্য ওই রাজ্যে তৃণমূলের একমাত্র বিধায়ককে বারণ করা হয়েছিল, তিনি যেন ওই নির্দল প্রার্থীকে সমর্থন না করেন। কার্যক্ষেত্রে যদিও অসমের তৃণমূল বিধায়কের ভোট বাতিল হয়েছে। কিন্তু তৃণমূল নেত্রীর যুক্তি, আদর্শগত অবস্থান থেকেই তাঁরা ওই নির্দলকে সমর্থন না-করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বামেরা এখানে তা করতে পারেনি। কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্ক আছে দেখেও তারা নির্দল মালিহাবাদিকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এই অভিযোগের জবাবে বাম ও কংগ্রেস, দুই শিবিরই বলছে, তারা কেউ কাউকে ভোট দেয়নি। নির্দল মালিহাবাদি কোনও দলের প্রার্থী হলে তিনি কখনওই অন্য পক্ষের ভোট পেতেন না। কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়া বলেছেন, "তৃণমূল নেত্রী নিজেই বামেদের সমর্থন নিয়ে নিজের প্রার্থীকে জেতালেন। আর আঁতাঁতের অভিযোগ তুলছেন আমাদের দিকে!"
অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের এই আবহে দুই শিবিরের দুই পরিচিত বিক্ষুব্ধ বিধায়ক এ দিন দু'রকম কাজ করেছেন। বাম প্রার্থীকে নিয়ে প্রবল আপত্তি জানিয়েও কার্যক্ষেত্রে ঋতব্রতকেই ভোট দিয়েছেন সিপিএমের আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা। আর শিখাদেবী মালিহাবাদিকে। ভোটের লাইনে তৃণমূল বিধায়কদের টিপ্পনির জবাবে রেজ্জাকের কটাক্ষ: "আপনারা বলেন, আমি আপনাদের লোক। তা হলে আমি তৃণমূলের লোক হয়েও সিপিএম-কে ভোট দিলাম, এটা তো আপনাদের দিকে ভাঙন!"
ফল জানার পরে (কমিশনের তরফে রাত পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হয়নি) তৃণমূলের জয়ী সাংসদ মিঠুন, যোগেন ও ইমরান জানান, দলনেত্রীর নির্দেশে তাঁরা এ রাজ্যের জন্য দিল্লিতে সক্রিয় হবেন। মিঠুন বলেন, "আমার একটা পরিকল্পনা আছে। দিদিকে বলার পরে তিনি 'হ্যাঁ' না বলা পর্যন্ত প্রকাশ্যে বলতে পারছি না!"
|
“বাংলায় এ সব হয় না। তৃণমূল স্বচ্ছ দল। কংগ্রেস-সিপিএম এক হয়েছিল বলেই নীতিগত ভাবে ওঁদের অনেকে সমর্থন করতে পারেননি।” — মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় |
“টাকা পয়সার খেলা অনেক দিন ধরেই চলছে। বাজার সরকার ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই ভোটে সেটা আবার প্রমাণিত।” — সূর্যকান্ত মিশ্র |
“বাংলার মুখে চুন-কালি লেপে দিয়েছে তৃণমূল। উত্তরের কিছু রাজ্যের মতো আমরাও গরু-ছাগল কেনাবেচার রাজনীতিতে সামিল হয়ে গেলাম।” —প্রদীপ ভট্টাচার্য |
|
পুরনো খবর: হুমকি ও টাকার খেলা, নালিশ বিরোধী পক্ষের |
|
|
|
|
|