হুমকি ও টাকার খেলা, নালিশ বিরোধী পক্ষের
রাজ্যসভার ভোটে ক্রসভোটিং এর আগে দেখেছে পশ্চিমবঙ্গ। কিন্তু বৃহস্পতিবার, পাঁচটি আসনে ভোটের আগের দিন, দিনভর যা ঘটল, তা এক কথায় নজিরবিহীন।
দুই বাম বিধায়কের খোঁজ মিলল না গোটা দিন। তাঁদের এক জনের নামে নিখোঁজ ডায়েরি দায়ের হল থানায়। তিনিই আবার রাতে সংবাদমাধ্যমের কাছে ফোন করে জানালেন, তিনি ভাল আছেন। অন্য এক বাম বিধায়ক জানিয়েই দিলেন, তিনি ভোট দেবেন শাসক পক্ষকে। আরও তিন বাম বিধায়ক অভিযোগ করলেন, তাঁদের টাকার লোভ ও ভয় দেখিয়ে ভোট কিনতে চাইছে তৃণমূল। কংগ্রেস শিবিরেও টানাপোড়েন হল দুই বিধায়ককে নিয়ে।
এবং এ সবের জেরে দিল্লিতে নির্বাচন কমিশনের কাছে বাম-কংগ্রেস দুই বিরোধী শিবিরই অভিযোগ করল, যা পরিস্থিতি তাতে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তৃণমূলের অবশ্য পাল্টা বক্তব্য, কেউ অভিযোগ করতেই পারেন। কিন্তু সেটা প্রমাণ করতে হবে তো!
শুক্রবার এ রাজ্য থেকে রাজ্যসভার যে পাঁচটি আসনের জন্য ভোট হবে তার চারটি নিয়ে বিশেষ জটিলতা নেই। বিধায়ক সংখ্যার নিরিখে তৃণমূলের তিন প্রার্থী মিঠুন চক্রবর্তী, কে ডি সিংহ ও যোগেন চৌধুরী এবং সিপিএমের ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্বাচন এক প্রকার নিশ্চিত (অঙ্ক বলছে, প্রত্যেক প্রার্থীর ৪৯টি প্রথম পছন্দের ভোট লাগবে)। টানাপোড়েন পঞ্চম আসনটি নিয়ে। ওই আসনে তৃণমূলের প্রার্থী আহমেদ হাসান (ইমরান) আর কংগ্রেস সমর্থিত নির্দল প্রার্থী আহমেদ সৈয়দ মালিহাবাদি। মালিহাবাদিকে সমর্থন করার কথা ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছে বামফ্রন্ট।
পঞ্চম আসনটি জেতার জন্য যা ভোট দরকার, তৃণমূলের হাতে তার চেয়ে গোটা পাঁচেক ভোট কম আছে। অন্য দিকে কংগ্রেসের ৩৮ বিধায়কের সঙ্গে বামেদের উদ্বৃত্ত ১২টি ভোট যোগ হলে মালিহাবাদির জয় নিশ্চিত হয়ে যায়। সেই অঙ্ক বানচাল করে নিজেদের প্রার্থীকে জেতাতেই তৃণমূল বিরোধী বিধায়কদের ভাঙানোর চেষ্টা করছে বলে বাম-কংগ্রেসের অভিযোগ।
বিধায়ক কেনাবেচার জল্পনা ঘোরাফেরা করেছে মূলত আট জনকে ঘিরে। এ দিন বামফ্রন্টের সব শরিক দলই আলাদা আলাদা ভাবে তাদের বিধায়কদের বৈঠকে ডেকেছিল। আরএসপি-র বৈঠকে হাজির হননি ময়নাগুড়ির বিধায়ক অনন্তদেব অধিকারী ও কুমারগ্রামের বিধায়ক দশরথ তিরকে। এঁদের সঙ্গে যোগাযোগই করতে পারেনি দল। রাতে এবিপি আনন্দকে ফোন করে অনন্তদেব জানান, তিনি ভালই আছেন এবং কলকাতাতেই আছেন। যদিও অনন্তদেব নিখোঁজ বলে পার্ক স্ট্রিট থানায় অভিযোগ দায়ের করেছে আরএসপি। দশরথের ক্ষেত্রে অবশ্য কোনও নিখোঁজ ডায়েরি হয়নি।
দলের বৈঠকে ছিলেন না গলসির ফরওয়ার্ড ব্লক বিধায়ক সুনীল মণ্ডলও। বিকেলে তাঁর বাড়ির সামনে বিক্ষোভ দেখান সমর্থকেরা। শুক্রবার তৃণমূল প্রার্থীকেই ভোট দেবেন বলে জানিয়ে রাতে সুনীলবাবু ফোনে বলেন, “বামফ্রন্টের নাম করে শরিক দলগুলির উপরে সিপিএমের তাঁবেদারি করা অর্থহীন! শরিকদের বহু বিধায়কই প্রতিবাদ করতে চেয়ে পারেন না। আমি, অনন্ত ও দশরথ তা করলাম! নিচুতলার কর্মীদের সঙ্গে কথা বলেই তৃণমূলে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
সুনীলবাবু স্বেচ্ছায় তৃণমূলে যাচ্ছেন বলে জানালেও বামফ্রন্টের তিন বিধায়ক কিন্তু শাসক দলের বিরুদ্ধে ভয় দেখানো ও টাকার টোপ দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। এঁরা ফব-র ধীরেন মাহাতো (জয়পুর) ও বিজয় বাগদি (দুবরাজপুর) এবং সিপিএমের সুশান্ত বেসরা (বান্দোয়ান)। তাঁদের পাশে নিয়ে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রবীন দেববলেন, “এঁদের টাকার প্রলোভন, লোকসভার টিকিট এবং ভয় দেখিয়ে নিজেদের দিকে টানার চেষ্টা করেছিল তৃণমূল।” বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসুর অভিযোগ, “বিধায়ক কেনাবেচার এই নোংরা রাজনীতি এ রাজ্যে ছিল না। তৃণমূল আমদানি করল!”
অভিযোগ উড়িয়ে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “তৃণমূল কাউকে জোর করে না। হেরে যাওয়ার ভয়ে ওঁরা এ সব বলছেন!”
তবে তৃণমূলের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছে কংগ্রেসও। এ দিন তারাও দলীয় বিধায়কদের বৈঠক ডেকেছিল। সেখানে আট জন আসেননি। ছ’জনের সঙ্গে যোগাযোগ করে না-আসার কারণ জানা গেলেও গোড়ায় সুজাপুরের বিধায়ক আবু নাসের খান চৌধুরী এবং গাজোলের বিধায়ক সুশীল রায়ের খোঁজ মেলেনি। মালিহাবাদির দেওয়া নৈশভোজেও তাঁরা আসেননি। সুশীল তাঁদের দলে যোগ দিচ্ছেন বলে একটা সময় দাবিও করেন তৃণমূল নেতৃত্ব। রাতে অবশ্য সুশীল কংগ্রেস নেতাদের জানান, তিনি ভোট দিতে যাবেন। কিন্তু ভোট কাকে দেবেন, তা নিয়ে সংশয় কাটেনি।
আবু নাসের বৈঠকে না-গেলেও বিধানসভায় তাঁকে তৃণমূলের ঘরে দেখা যাওয়ায় জল্পনা জোরদার হয়। দিনভর উৎকণ্ঠার পরে কংগ্রেস নেতারা তাঁর কলকাতার বাড়িতে গেলে আবু নাসের জানান, তিনি কংগ্রেসেই আছেন, শুক্রবার ভোট দিতেও আসবেন। এই পরিস্থিতিতে কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়ার অভিযোগ, “রাজ্যসভার ভোটের আগে বাংলার রাজনীতিতে অনৈতিক ও ঘৃণ্য ভাবে বিধায়ক কেনাবেচা শুরু করেছে শাসক দল!”
যার জবাবে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের পাল্টা প্রশ্ন, “দলের প্রার্থী দাঁড় না-করিয়ে সিপিএমের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কেন এক জন নির্দলকে ওঁরা (কংগ্রেস) সমর্থন করছেন? কেন জোর গলায় বলছেন না, ওঁদের সঙ্গে সিপিএমের আঁতাঁত রয়েছে?”
বৃহস্পতিবারের ঘটনাপ্রবাহের পরে শুক্রবার বিধানসভায় কী হয়, তা নিয়ে উত্তেজনা জিইয়ে রইল। রাজ্যসভার ভোট গোপন ব্যালটে হয় না। কাকে ভোট দিচ্ছেন, তা এজেন্টকে দেখিয়ে ব্যালট ফেলতে হয় ভোটবাক্সে। না হলে ব্যালট বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু তাই বলে কাকে ভোট দিতে হবে, তা নিয়ে দলের তরফে নির্দেশিকাও (হুইপ) জারি করা যায় না। ফলে দলের পছন্দের প্রার্থীর বদলে অন্য কাউকে ভোট দিলে শুধু দলীয় স্তরেই সংশ্লিষ্ট বিধায়কের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। তাঁর বিধায়ক পদ খারিজ করা যাবে না।
আইনের বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বিধানসভার প্রাক্তন স্পিকার হাসিম আব্দুল হালিম বলেন, “দলত্যাগ-বিরোধী আইন রাজ্যসভার ভোটে কার্যকর হয় না। তবে দলের কথার বাইরে গিয়ে কেউ ভোট দিলেন কি না, দল সেটা চিহ্নিত করতে পারে। সেই জন্যই দেখিয়ে ভোট দিতে হয়।” এই সুযোগ নিয়েই বিধায়কদের ভাঙানো হচ্ছে বলে অভিযোগ। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের কথায়, “বিধায়কদেরও নিরাপত্তা নেই! তিনটে অভিযোগ করেছি।”
তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য অভিযোগ ভিত্তিহীন জানিয়ে দাবি করেন, তাঁদের চার প্রার্থীরই জয় নিশ্চিত। তৃণমূলের একমাত্র উদ্বেগ সদ্য দলত্যাগী নেতা সোমেন মিত্রের স্ত্রী শিখা মিত্রকে নিয়ে। দল থেকে সাসপেন্ড হওয়া এই বিধায়ক কোন দিকে ভোট দেন সেটা দেখার।
বামেদের প্রথম লক্ষ্য নিজেদের প্রার্থীকে জেতানো। তার পর উদ্বৃত্ত ভোট দিয়ে নির্দল মালিহাবাদিকে জেতানোর চেষ্টা করা। আজ সকালে সব বাম বিধায়ককে বিধানসভায় থাকতে বলা হয়েছে। এ দিন দলীয় বৈঠকে আসেননি আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা। তবে তিনি ভোট দিতে যাবেন বলে জানিয়েছেন। প্রবীণ সিপিএম বিধায়ক নারায়ণ মুখোপাধ্যায় হাসপাতালে। ডাক্তারদের সম্মতি নিয়ে ভোট দেওয়ার চেষ্টায় আছেন। বাম নেতৃত্ব অবশ্য রেজ্জাক-সহ ৫৭ জনকে পাবেন ধরেই অঙ্ক সাজাচ্ছেন। কোন বাম বিধায়ক কোন প্রার্থীকে (ঋতব্রত না মালিহাবাদি) ভোট দেবেন তা এখনও ঠিক হয়নি। পরিস্থিতি ও অঙ্ক বিচার করে আজ সকালেই ঠিক হবে, শেষ পর্যন্ত কে কাকে প্রথম পছন্দের ভোট দেবেন।

নজরদারি পর্যবেক্ষকের
রাজ্যসভার ভোট নিয়ে যে অভিযোগ উঠেছে, তা খতিয়ে দেখতে খোঁজখবর শুরু করলেন নির্বাচন কমিশনের বিশেষ পর্যবেক্ষক অনিতা কারওয়াল। রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে কথা বলা ছাড়াও থানায় দায়ের করা অভিযোগ নিয়েও খোঁজ নিয়েছেন তিনি। আজ, শুক্রবার ভোটের দিনের গতিপ্রকৃতির উপর তিনি নজর রাখবেন। বিশেষ করে যে বিধায়কের নিখোঁজ হওয়া নিয়ে পার্ক স্ট্রিট থানায় অভিযোগ হয়েছে, সেই অনন্তদেব অধিকারীর বিষয়েও অনিতাদেবী নজর রাখবেন। প্রশ্ন উঠেছে, রাজ্যসভার ভোট কি স্থগিত হয়ে যেতে পারে? কমিশন সূত্রে বলা হচ্ছে, ভোট স্থগিত না হলেও গণনার আগে রিটার্নিং অফিসারকে কমিশনের অনুমতি নিতে হয়। তার আগে পর্যবেক্ষকের রিপোর্ট খতিয়ে দেখবে কমিশন। যদি দেখা যায় গণনা স্থগিত রাখা প্রয়োজন, তা হলে কমিশন গণনার অনুমতি না-ও দিতে পারে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.