কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে সিবিআই নন্দীগ্রাম-কাণ্ডের তদন্ত করে আদালতে যে চার্জশিট পেশ করেছে, রাজ্য সরকার তাতে সন্তুষ্ট নয়। ঘটনাটি নিয়ে তাই নতুন করে সিবিআই-তদন্তের আর্জি জানাল সরকার।
সিবিআই সম্প্রতি হলদিয়া আদালতে চার্জশিট জমা দিয়ে বলেছে, ২০০৭ সালে ১৪ মার্চ নন্দীগ্রামে সশস্ত্র জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ বাধ্য হয়ে গুলি চালিয়েছিল। এই চার্জশিট যে তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়, রাজ্য সরকার তা আগেই জানিয়ে দিয়েছে। আর এক ধাপ এগিয়ে এ বার হাইকোর্টের কাছে সরকারের আর্জি, নতুন তদন্তকারী অফিসার নিয়োগ করে সিবিআই-কে তদন্ত করতে বলা হোক। সিবিআই অবশ্য রাজ্যের আর্জিকে অবাস্তব হিসেবে অভিহিত করে আদালতকে জানিয়েছে, এই মামলায় নতুন ভাবে তদন্ত করার প্রয়োজন নেই। কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অসীম বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডিভিশন বেঞ্চে মামলার পরবর্তী শুনানি হবে আগামী মঙ্গলবার।
নন্দীগ্রামে পুলিশি গুলিচালনার পর দিনই হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সিবিআই-কে ঘটনা সম্পর্কে তদন্ত করতে বলে। সেই তদন্তের অগ্রগতি জানতে গত বছর হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন নন্দীগ্রামের বাসিন্দা সুকুমার জানা-সহ নন্দীগ্রাম-কাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত একাধিক ব্যক্তি। এ দিন ওই মামলার শুনানি চলার সময়ই সরকারি কৌঁসুলি রাজদীপ মজুমদার সিবিআই-চার্জশিটের প্রসঙ্গটি তোলেন।
সওয়ালে সরকারি কৌঁসুলি বলেন, সিবিআই দু’টো চার্জশিট পেশ করেছে। তাতে পুলিশকে কোনও দোষ দেওয়া হয়নি, উল্টে গুলিচালনায় বৈধতার তকমা দেওয়া হয়েছে। অথচ কলকাতা হাইকোর্টের তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি এসএস নিজ্জর ও বিচারপতি পিনাকী ঘোষের ডিভিশন বেঞ্চ গুলিচালনাকে অবৈধ ও অসাংবিধানিক হিসেবে অভিহিত করে সিবিআই-কে তদন্তভার নিতে বলেছিল। “হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ যেখানে গুলিচালনাকে অসাংবিধানিক বলে জানিয়েছে, সেখানে সিবিআই তাকে বৈধ বলে আখ্যা দিল কী ভাবে?” প্রশ্ন রাজদীপবাবুর।
এবং এমতাবস্থায় বেঞ্চের প্রতি তাঁর আর্জি: হাইকোর্টের ঠিক করে দেওয়া তদন্তকারী অফিসার দিয়ে নতুন করে নন্দীগ্রাম-কাণ্ডের তদন্ত হোক। পাশাপাশি বিচারপতি ও অভিজ্ঞ আইনজীবীদের নিয়ে তদন্ত কমিটিও গড়ে দিক হাইকোর্ট, যারা আলাদা ভাবে নন্দীগ্রাম-কাণ্ডের তদন্ত করবে।
অন্য দিকে সিবিআইয়ের তরফে সরকারের যুক্তি নস্যাৎ করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরোর কৌঁসুলি আশরফ আলি এ দিন তাঁর সওয়ালে দাবি করেন, সিবিআই দীর্ঘ দিন ধরে অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে মামলাটির তদন্ত করেছে। তাই নতুন তদন্তের কোনও অবকাশ নেই। সিবিআইয়ের কৌঁসুলির বক্তব্য: নন্দীগ্রাম সংক্রান্ত মোট সাতটি মামলা দায়ের হয়েছিল। সারবত্তা না-থাকায় চারটির তদন্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়। দু’টো মামলার তদন্ত সেরে সম্প্রতি হলদিয়া কোর্টে চার্জশিট পেশ হয়েছে। বাকি একটার ক্ষেত্রে ছয় পুলিশ অফিসার ও এক চিকিৎসককে জেরা করতে রাজ্য সরকারের অনুমতি চেয়েছিল সিবিআই। সরকার অনুমতি দেয়নি। ফলে পুলিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। তদন্ত-ও শেষ করা যাচ্ছে না।
এ দিকে সিবিআইয়ের চার্জশিটকে চ্যালেঞ্জ করে এ দিনই হাইকোর্টে একটি মামলা করেছেন ৭ নম্বর জালপাই গ্রামের বাসিন্দা বাদল মণ্ডলের স্ত্রী কবিতাদেবী-সহ কয়েক জন। ১৪ মার্চের ঘটনায় বাদলবাবুর মৃত্যু হয়। আবেদনকারীদের বক্তব্য: হাইকোর্ট গুলিচালনাকে অবৈধ আখ্যা দিয়ে ঘটনায় জড়িতদের ধরার নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু সিবিআই হাইকোর্টের নির্দেশ মান্য করেনি। ১৪ মার্চের ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবিও জানিয়েছেন আবেদনকারীরা।
হলদিয়া কোর্টের নন্দীগ্রাম-কাণ্ডের দুই মামলায় যে চার্জশিট সিবিআই পেশ করেছে, তাতে রাজ্য সরকারের অস্বস্তি যেমন বেড়েছে, তেমন ক্ষতিগ্রস্তদের পরিবারেরাও হতাশ। কারণ কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাটির চার্জশিটে পরিষ্কার বলা হয়েছে, সে দিন নন্দীগ্রামে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি-র সমর্থকদের সশস্ত্র হামলা ঠেকাতেই পুলিশ গুলি চালাতে বাধ্য হয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, ওই দিনের আন্দোলনকারীদের মধ্যে ১৬৬ জনের বিরুদ্ধে পুলিশের উপরে হামলা চালানোর অভিযোগও আনা হয়েছে সিবিআইয়ের চার্জশিটে।
|