দক্ষিণবঙ্গের যে অঞ্চলের শিল্পায়নে রাজ্য সরকার গতি আনতে চাইছে, পুরুলিয়ার সেই রঘুনাথপুরেই বন্ধ হয়ে গেল একটি জলের পাইপ তৈরির কারখানা। এই ঘটনার জন্য এলাকার কিছু তৃণমূল নেতা -কর্মীকে দুষছেন শ্রমিকেরা। অভিযোগ, শাসক দলের ওই নেতা -কর্মীর ইন্ধনে কারখানায় ভাঙচুর হয়েছে। কর্মীরা মার খেয়েছেন। রঘুনাথপুরের মতো শিল্পাঞ্চলে এমন ঘটনায় অস্বস্তিতে পড়েছেন পুরুলিয়া জেলা তৃণমূল নেতৃত্ব।
রঘুনাথপুর ২ ব্লকের গোবরান্দা গ্রামে ২০০৪ সালে প্রায় একশো কোটি টাকা ব্যয়ে ওই পিভিসি পাইপ তৈরির কারখানা গড়েন কলকাতার শিল্পোদ্যোগী অঞ্জন মজুমদার। সব মিলিয়ে কারখানাটিতে দুশোরও বেশি কর্মী -শ্রমিক। শ্রমিকেরা এলাকারই বাসিন্দা। এই কারখানার মালিকপক্ষেরই আর একটি ঠিকা সংস্থায় শ্রমিকের কাজ করতেন গোবরান্দা গ্রামের বিনোদ বাউরি। ২ তারিখ পুরুলিয়ারই বোরো থানা এলাকায় কর্মরত অবস্থায় দুর্ঘটনার শিকার হন তিনি। হাসপাতালে মৃত্যু হয়। বৃহস্পতিবার মৃতদেহ গ্রামে আসার পরে দেহ নিয়ে পথ অবরোধ হয়। সামিল ছিলেন এলাকার কিছু তৃণমূল নেতা -কর্মী। পরে দেহ নিয়েই কারখানায় যান বিক্ষোভকারীরা।
অভিযোগ, ক্ষতিপূরণ ও চাকরি নিয়ে আলোচনার সময় বিক্ষোভকারীরা কারখানায় ভাঙচুর চালান। মারধর করা হয় কারখানা পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা তিন কর্মী দুষ্মন্ত প্রধান, অনন্ত মান্না ও অমলেশ মাইতিকে। তিন জনই পুরুলিয়া সদর হাসপাতালে ভর্তি। তৃণমূলের ব্লক সভাপতি বরুণ মেহেতা, ব্লক কমিটির সদস্য রামলাল পাঠক -সহ দলের ছয় নেতা -কর্মীর বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দায়ের করেন কারখানা কর্তৃপক্ষ। |
ভাঙচুরের পরে।—নিজস্ব চিত্র। |
শুক্রবার অনির্দিষ্ট কালের জন্য কারখানা বন্ধ থাকার নোটিস ঝোলান কর্তৃপক্ষ। অঞ্জনবাবু বলেন, “আলোচনা শুরু হওয়ার মুখেই স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের নেতৃত্বে ভাঙচুর ও মারধর শুরু হয়। এখানে দুশো কোটি টাকা বিনিয়োগ করে পাশাপাশি দু’টি কারখানা গড়েছি। কিন্তু যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছি, তার পর এই এলাকায় শিল্পায়নের প্রক্রিয়া কতটা ফলপ্রসূ হবে, তা নিয়ে সংশয় থাকছে।” তিনি জানান, কারখানার কর্মী -শ্রমিকেরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তাই কারখানা চালানো সম্ভব নয়।
রুজি হারানোর আশঙ্কায় অভিযুক্ত নেতা -কর্মীদের বিরুদ্ধে এ দিন ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন কারখানার শ্রমিকেরা। কারখানায় হামলার প্রতিবাদে গোবরান্দা গ্রামে তাঁরা এ দিন মিছিলও করেন। নিজেদের তৃণমূল সমর্থক বলেই দাবি করে ওই গ্রামেরই বাসিন্দা তথা শ্রমিক উৎপল বাউরি, নয়ন চক্রবর্তী, কালীপদ বাউরি, অরূপ চক্রবর্তীরা বলেন, “কেন এই ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে আমাদের রুজি -রোজগার বন্ধ করে দেওয়া হল, তা জানতে এ দিন অভিযুক্ত নেতা -কর্মীদের বাড়িতেও গিয়েছিলাম। ওঁরা বাড়িতে না থাকায় জবাব পেলাম না।” শ্রমিকদের একাংশের আরও ক্ষোভ, “আমরা জেনেছি, মালিক বিনোদের স্ত্রীকে কারখানায় চাকরি ও তাঁর সন্তানের পড়াশোনার খরচ দেবেন বলেছিলেন। তার পরেও ভাঙচুর মেনে নেওয়া যায় না।” জেলা তৃণমূলের নেতা অমর মাহাতো বা দলের রঘুনাথপুর ২ ব্লক কমিটির সদস্য নান্টু সরকার বলেন, “এই হামলার জেরে কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনায় এলাকায় শিল্পায়নের প্রক্রিয়াই ব্যাহত হল। দলের ভাবমূর্তিরও ক্ষতি হল।”
অভিযুক্ত নেতা -কর্মীদের কাউকেই পুলিশ এখনও ধরেনি। তৃণমূল সূত্রের খবর, এ দিন অভিযুক্তেরা দিনভর পুরুলিয়ায় দলের জেলা নেতাদের কাছে গিয়ে ঘটনার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ব্লক সভাপতি বরুণ মেহেতার বিরোধী গোষ্ঠী আগেই তাঁর বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ জানিয়েছে নেতৃত্বের কাছে। এ দিন বরুণবাবু বলেন, “নেতাদের জানিয়েছি, শ্রমিকের দেহ আসার পরে বৃহস্পতিবার রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে নিজের সামাজিক দায় মেটাতে এলাকায় যাই। দেহ নিয়ে পথ অবরোধ হচ্ছে দেখে তা তুলতে উদ্যোগী হয়েছিলাম। সেখানে স্থানীয় বাসিন্দারা উত্তেজিত হয়ে কিছু ঘটিয়েছেন।” এর পিছনে কোনও রাজনৈতিক ইন্ধন বা মদত ছিল না বলেই তাঁর দাবি।
জেলা তৃণমূল সভাপতি, রাজ্যের মন্ত্রী শান্তিরাম মাহাতোর বক্তব্য, “নিরাপত্তা সংক্রান্ত সমস্যা হবে না। পুলিশ -প্রশাসনকে বিষয়টি দেখতে বলা হয়েছে। কর্তৃপক্ষকে দ্রুত কারখানা খুলতে বলেছি।” দলের জেলা কার্যকরী সভাপতি সুজয় বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃপক্ষকে একই অনুরোধ করেছেন। যদিও অঞ্জনবাবু বলেন, “সুজয়বাবুকে বলেছি, কর্মীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। কারখানা খোলা সম্ভব নয়।” |