খবর পেয়ে গ্রামে পৌঁছে ১৩ বছরের এক নাবালিকার বিয়ে রুখলেন বিডিও। শুক্রবার রামপুরহাট ১ ব্লকের হস্তিকাঁদা গ্রামের ঘটনা। বাল্যবিবাহ কেন আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ, তা মেয়েটির বাবা ও মা-কে বোঝান তিনি। শেষে ১৮ বছর বয়স না হওয়া অবধি মেয়ের বিয়ে দেবেন না বলে মুচলেকা দিয়েছেন ওই নাবালিকার বাবা।
রামপুরহাট ১ বিডিও শ্রেয়সী ঘোষ বলেন, “আমি খবর পেয়েই ওই গ্রামে ব্লক থেকে লোক পাঠিয়ে নাবালিকা কিশোরীটির বাবাকে এ নিয়ে প্রাথমিক ভাবে সচেতনা করার চেষ্টা করেছিলাম। শুক্রবার তাঁকে অফিসে আসার জন্য অনুরোধও করেছিলাম। কিন্তু তিনি আসেননি। তাই এ দিনই মেয়েটির বাড়ি গিয়ে বিয়ে রুখতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করেছি। যত দূর জানি ছেলেটিরও এখন বিয়ে করার বয়স হয়নি।” তাঁর সংযোজন, “আমি নিজে এক জন মহিলা। তারই সঙ্গে বিডিও হিসেবেও এই ধরনের অন্যায় কাজকে মেনে নিতে পারি না।”
মেয়েটির পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, স্থানীয় একটি জুনিয়র হাইস্কুলে মেয়েটি পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। এ বছর তাকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি না করে বাবা-মা মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছিলেন সাঁইথিয়া পুরসভার ১১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা, পেশায় রাজমিস্ত্রি ১৮ বছরের এক যুবকের সঙ্গে। আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি বিয়ের দিন ঠিক হয়েছিল। কিশোরীর বাবা বলেন, “আমি শারীরিক ভাবে দুর্বল। তাই কম কাজ করতে পারি।
|
এখনও সমাজের বহু ক্ষেত্রেই শিক্ষার অভাব দূর করা যায়নি। তার উপরে রয়েছে আর্থিক
সমস্যা। সব মিলিয়ে একটা অংশের মধ্যে মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার ঝোঁক
এখনও রয়েছে। আমরা বাল্য বিবাহ রুখতে আরও সচেতনা বাড়াব।
শ্রেয়সী ঘোষ, বিডিও রামপুরহাট ১ |
|
ভাল পাত্র পেয়েছিলাম। সেই জন্য তাকে হাতছাড়া করতে চাইনি। বিয়ে দিতে রাজি হয়ে যাই।” তাঁর যুক্তি, “গ্রামে এ রকম অল্পবয়সে তো কত ছেলেমেয়েরই বিয়ে হচ্ছে। তাই আমরাও মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছিলাম।” তাঁর কথা থেকেই স্পষ্ট, মেয়েদের ১৮ এবং ছেলেদের ২১ বছরের নীচে বিয়ে দেওয়া যে আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ, সে বিষয়ে সচেতনই নন ওই এলাকার মানুষ। অতীতে বহু ক্ষেত্রেই এমন বিয়ে হলেও প্রশাসনের দিক থেকে তা রুখতে তেমন সক্রিয়তা দেখা যায়নি বলেই অভিযোগ। এ নিয়ে প্রতিটি এলাকায় যে সচেতনতা গড়ে তোলা দরকার তা-ও হয়নি বলেই অভিযোগ। এত দিনেও ওই সব এলাকায় বাল্যবিবাহ বিরোধী মনোভাব গড়ে না ওঠার পিছনে সমাজকর্মীরা প্রশাসনিক দায়বদ্ধতার পাশাপাশি শিক্ষার অভাব ও দারিদ্রকেই দুষছেন।
এ দিন দুপুরে ওই গ্রামে গিয়ে দেখা যায় এক শতক জায়গার উপর মাটির একচালা ঘরে বাস করে ওই পরিবার। কিশোরীর বাবার দিনমজুরিতেই সংসার চলে। তাঁর ১০০ দিন কাজের প্রকল্পে জবকার্ডও রয়েছে। কিন্তু সব দিন তিনি কাজ পান না বলে অভিযোগ। দুপুর দেড়টা নাগাদ মেয়েটির ওই বাড়িতে বিডিও পৌঁছন। প্রথমে তিনি কিশোরীর বাবা ও মায়ের সঙ্গে কথা বলেন। শ্রেয়সীদেবী বোঝান এই বিয়ে দিলে তা দেশের আইন বিরুদ্ধ হবে। এমন অল্প বয়সে বিয়ে দিলে তাঁরা ভবিষ্যতে মেয়েরই বিপদ ডেকে আনবেন বলেও তিনি দু’জনকে সচেতন করেন। এরপরেই বিডিও সাদা কাগজে কিশোরীর বাবার কাছ থেকে একটি মুচলেকা লিখে নেন। তাতে তিনি ১৮ বছর বয়স না হলে মেয়ের বিয়ে দেবেন না বলে সম্মত হন। দেশের ওই আইনের কথা না জেনেই তিনি মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছিলেন, তাও ওই মুচলেকায় লেখেন। পরে নাবালিকাকে বিডিও নিজের কাছে ডেকে নেন। শ্রেয়সীদেবী মেয়েটিকে নতুন ক্লাসে ভর্তি হয়ে স্কুল থেকে নতুন বই, ইউনিফর্ম নিয়ে পড়াশোনা করার জন্য উৎসাহী করেন। এ ব্যাপারে এবং মেয়েটি যাতে রাজ্য সরকারের ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্পের সুযোগ-সুবিধা পায়, সে বিষয়টিও দেখার আশ্বাস দেন। সেই সঙ্গে তার বাবা যাতে ১০০ দিন প্রকল্পে ঠিকমতো কাজ পান, তা-ও বিডিও দেখবেন বলে জানিয়েছেন। মেয়েটির স্কুলের ‘টিচার-ইন-চার্জ’ সংজ্ঞা অধিকারী বলেন, “গত নভেম্বর থেকেই মেয়েটি স্কুলে কম আসছিল। তখন ওর সহপাঠীদের কাছ থেকে জানতে পারি ওর বাবা-মা বিয়ে দেবে বলে ঠিক করছেন। তখনই মেয়েটিকে এবং ওর মাকে স্কুলে ডেকে আনা হয়েছিল। তিনি ১৮ বছর বয়স না হলে মেয়ের বিয়ে দেবেন না বলে আমাদের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন।” পরে মেয়েটি স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষায় বসেছিল। সব বিষয়ে পাশও করে। নতুন শিক্ষা বর্ষের জন্য স্কুলের ইউনিফর্ম তৈরি করার টাকা তুললেও মেয়েটি আর নতুন ক্লাসে ভর্তি হয়নি বলেই তিনি জানিয়েছেন। যদিও তারপরে স্কুল কর্তৃপক্ষও আর ওই মেয়েটির খোঁজ করেননি বলে অভিযোগ। বিডির-র কানে পৌঁছলেও বিষয়টি জানতেনই না সংশ্লিষ্ট কাষ্ঠগড়া পঞ্চায়েতের তৃণমূল প্রধান নিয়ামত আলি। একই বক্তব্য সংসদের নির্বাচিত তৃণমূলের সদস্যেরও। এ দিকে, মেয়েটির বাড়ির পাশেই থাকেন তার এক মামা। তিনি বলেন, “আমাদের সঙ্গে ওদের পরিবারের এখন কোনও সম্পর্ক নেই। তবু ওই অল্প বয়সে ভাগ্নীর বিয়ে হচ্ছে শুনে আপত্তি করেছিলাম। পরে দেখলাম ওদের নিজেদেরই কারও আপত্তি নেই, তখন আর কিছু বলিনি।” তাঁর মতোই মেয়েটির অন্য পাড়া প্রতিবেশীরাও নাবালিকা মেয়েটির বিয়েতে কোনও আপত্তি জানাননি। যে বয়সে মেয়েটির স্কুলে গিয়ে পড়াশোনা করার কথা, সেই বয়সে বই খাতা কেড়ে নিয়ে তাকে বিয়ের পিড়েতে বসার উপক্রম করা হয়েছিল। অথচ তা নিয়ে কেউ-ই প্রতিবাদ করেননি।
এ দিনের মেয়েটির খবর জানা ছিল না বলে দাবি করেছেন গ্রামের আশাকর্মী ইন্দুমতী মণ্ডল। তিনি বলছেন, “আমরা সাধ্যমতো বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে অল্প বয়সী ছেলেমেয়েদের যাতে বিয়ে না দেওয়া হয়, তার জন্য প্রচার করি। কিন্তু এ নিয়ে বেশি বলতে গেলে উল্টে আমাদেরই চাপে পড়তে হয়!” এ দিকে, ওই মেয়েটির সঙ্গে যার বিয়ে ঠিক হয়েছিল, তিনি সদ্য ১৮ ছুঁয়েছেন বলে জানা গিয়েছে। সে দিক থেকে দেখতে গেলে আইনত পাত্রেরও উপযুক্ত বয়স ছিল না। তা নিয়ে বলতেই ফোনে পঞ্চম শ্রেণি অবধি স্কুলে যাওয়া ওই পাত্র বলেন, “আমি জানি মেয়েদের ১৮ এবং ছেলেদের ২১ বছর বয়স না হলে বিয়ে দেওয়া আইনত অপরাধ। কিন্তু আমাদের সমাজে বা গরিব ঘরে ক’জন সে নিয়ম মানছে?” তাঁর পাল্টা হুমকি, “ওই মেয়েকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করব না। আজ না হোক, দু’মাস পরেও যে ভাবেই হোক ওকে বিয়ে করবই।” শ্রেয়সীদেবী এ দিন অবশ্য পাত্রপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি। পাত্রের এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, “সংশ্লিষ্ট বিডিও-র সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্যবস্থা নেব।” একই কথা জানিয়েছেন, সাঁইথিয়ার বিডিও জাহিদ সহুদ এবং পুরসভার পুরপ্রধান বিপ্লব দত্ত-ও। |