যা ছিল বুনিয়াদি শিক্ষার অহঙ্কার, সেখান থেকেই এখন খসে পড়ছে অবহেলার পলেস্তরা।
উত্তর ২৪ পরগনার হাবরার বাণীপুরে অধ্যক্ষ ও আবাসিকদের টানাপোড়েনে পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে সরকারি সম্পত্তি। সংস্কারের অভাবে নষ্ট হচ্ছে বিশাল আবাসন। অথচ থাকার জায়গা নেই বলে প্রতি দিন যাতায়াতে ভুগতে হচ্ছে দূর-দূরান্তের শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের।
গাঁধীজির বুনিয়াদি আর রবীন্দ্রনাথের হাতে-কলমে শিক্ষার আদর্শে স্বাধীনতার পরে বাণীপুরে তৈরি হয়েছিল বিশাল ক্যাম্পাস। অনেকটা বিশ্বভারতী-শ্রীনিকেতনের ধাঁচেই। প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য রাজ্যের প্রথম সরকারি শিক্ষক শিক্ষণ মহাবিদ্যালয়ও তৈরি হয়েছিল এখানেই। প্রায় ২০ বিঘে জমিতে তৈরি হয় মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মীদের আবাসন। মোট ১৬টি আবাসনে ৩২ জন শিক্ষক-অশিক্ষক কর্মচারির পরিবার থাকত। ক্যাম্পাসে থাকার পাশাপাশি চলত হাতে-কলমে কৃষিকাজ। গোটা এলাকা ভরে থাকত মরসুমি ফুলে-ফলে। |
এখন সেই আবাসনগুলিই পড়ে রয়েছে অন্ধকারে। সংস্কার হয়নি। বিভিন্ন কলেজের অশিক্ষক কর্মচারির খান দশেক পরিবার কোনও মতে থাকে। ছাদ ভেঙে গিয়েছে। দেওয়াল থেকে খসে পড়ছে পলেস্তরা। কোনও-কোনও আবাসনে আর থাকার উপায় নেই। ঘরের মধ্যে গাছ গজিয়েছে। আগাছা-জঙ্গলে ভরে গিয়েছে গোটা এলাকা। রাতের অন্ধকারে সেখানে অবাধে চলে চোলাই, নেশার ঠেক।
কেন এই হাল?
প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গিয়েছে, ১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বরে বাণীপুরে এ রাজ্যের প্রথম নিম্ন বুনিয়াদি শিক্ষক শিক্ষণ মহাবদ্যালয়টি তৈরি হয়। ওই বছরের শেষের দিকেই তৈরি হয় স্নাতোকত্তর বুনিয়াদি শিক্ষক শিক্ষণ মহাবিদ্যালয়। বাণীপুরের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব সামাল দেওয়া হত এই মহাবিদ্যালয় থেকেই। প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন হিমাংশুবিমল মজুমদার, যিনি স্থানীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তথা বাণীপুর লোক উৎসবের প্রধান পথিকৃৎ। মহাবিদ্যালয়টি ছিল পুরোপুরি আবাসিক। শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীরা থাকতেন ক্যাম্পাসেই। পরে ওই ক্যাম্পাসেই আরও একটি করে নিম্ন ও উচ্চ বুনিয়াদি শিক্ষক শিক্ষণ মহাবিদ্যালয় তৈরি হয়। কলকাতা থেকে রাজ্যের প্রাচীনতম শরীরশিক্ষা শিক্ষণ মহাবিদ্যালয়টিকেও নিয়ে আসা হয় সেখানে। পঞ্চম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বাণীপুরে জনতা মহাবিদ্যালয় তৈরি হয় গ্রাম সেবকদের প্রশিক্ষণের জন্য।
শিক্ষকেরা জানান, আগে শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী ও শিক্ষার্থী সবাইকে কায়িক শ্রম দিয়ে উৎপাদনমূলক কাজে যোগ দিতে হত। তার ফলেই গোটা ক্যাম্পাস ও আবাসন ভরে থাকত ফুলে-ফলে। বিভিন্ন মরসুমি ফুল-ফল দেখতে সেখানে যেতেন আশপাশের মানুষ। কিন্তু প্রায় ১৫ বছর আগেই বন্ধ হয়ে যায় প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণের মহাবিদ্যালয়টি। ওই ক্যাম্পাসেই তৈরি হয় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য বিএড কলেজ। শিক্ষা দফতরের টাকায় বর্তমানে সেটি সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। লক্ষাধিক টাকা খরচ করে গেটও তৈরি হয়েছে। কিন্তু আবাসনটি পরে রয়েছে অবহেলায়।
আবাসনের বাসিন্দা তপন পাল বলেন, “বেশির ভাগ ঘরেই কেউ থাকে না। কোনও মতে আমরা এখনও রয়ে গিয়েছি। নিজেরাই পয়সা দিয়ে কিছুটা সারিয়ে নিয়েছি। বারবার অধ্যক্ষের কাছে দরবার করা হয়েছে। কিন্তু কোনও ব্যবস্থা হয়নি। সুন্দর জায়গাটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।” বিএড কলেজের অধ্যক্ষ হরেকৃষ্ণ মণ্ডল অবশ্য দাবি করেন, “পূর্ত দফতরের পক্ষ থেকে নতুন জায়গায় আটটি নতুন আবাসন তৈরি হয়েছে। পুরনো আবাসনের বাসিন্দাদের নোটিস দিয়ে বলা হয়েছে নতুন আবাসনে যাওয়ার জন্য। ওই বাড়িগুলি সংস্কার হবে। অথচ তাঁরা সরছেন না। সংস্কারের জন্য পূর্ত দফতরের টাকা এসে পড়ে রয়েছে।”
৪৩ বছর ধরে আবাসনে রয়েছেন বাণীপুর হোমের অশিক্ষক কর্মচারি পার্থ দত্ত। তাঁর পাল্টা দাবি, “এ সব মিথ্যা কথা। রাস্তার পাশে একটি জায়গায় নতুন কয়েকটি আবাসন করা হয়েছে। সেখানে ইতিমধ্যে অন্যেরা রয়েছে। আমরা থাকব কোথায়? আমরা এখানে থাকলেও বাড়িগুলি সংস্কার করা যায়। যে বহু ঘরে কেউ থাকে না, সেগুলিই তো আগে সংস্কার করা যেতে পারে।” দোষারোপ আর পাল্টা দোষারোপের টানাপোড়েনে ভুগছেন শুধু দূর-দূরান্তের শিক্ষক-কর্মীরা। |