নদিয়ায় রাতের রাস্তা কতটা নিরাপদ? বুধবার শান্তিপুরের সাহেবডাঙার ঘটনা ফের এই প্রশ্নটাই তুলে দিল। কী ঘটেছিল এ দিন? পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে খবর, কনেযাত্রী বোঝাই দু’টি বাস কোতয়ালির ভীমপুর থেকে রওনা দিয়েছিল শান্তিপুরের বেলগরিয়ার উদ্দেশে। অভিযোগ, রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ শান্তিপুরের সাহেবডাঙার কাছে জনা পঁচিশ যুবক পথ আটকায় ওই বাস দু’টির। সরস্বতী পুজোর চাঁদা হিসাবে যাত্রীদের কাছে পাঁচ হাজার টাকা জুলুম করা হয়। শেষপর্যন্ত যাত্রীরা পাঁচশো টাকা দিতে রাজি হয়। এরপর রেগে গিয়ে বেশ কিছু যুবক বাসে উঠে যাত্রীদের বেধড়ক পেটায়। মহিলাদের শ্লীলতাহানি করা হয় বলেও অভিযোগ। জখম হন অন্তত পনেরো জন। তাঁদের মধ্যে পাঁচ জনকে শান্তিপুর স্টেট জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা করামো হয়। জেলার পুলিশ সুপার সব্যসাচী রমণ মিশ্র বলেন, “চাঁদার জন্য কনেযাত্রীর গাড়িতে হামলার অভিযোগে ওই গ্রামের সনাতন ঘোষ নামে এক জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত অন্যদেরও চিহ্নিত করে গ্রেফতার করা হবে। এই ধরনের ঘটনা কোনওভাবেই বরদাস্ত করা হবে না।” তবে এই ঘটনার পর গ্রামে তল্লাশিতে গিয়ে রাতে তারস্বরে মাইক বাজানোর অভিযোগে পুলিশ আরও চার জনকে গ্রেফতার করেছে।
দিনকয়েক আগে কৃষ্ণনগরের ঝিটকেপোতা রাজ্য সড়কে রাতে দুষ্কৃতীদের খপ্পরে পড়েছিল ধুবুলিয়ার এক কনেযাত্রীদের গাড়ি। রাস্তায় গাছের গুঁড়ি ফেলে প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে অবাধে লুঠপাট চলেছিল। ওই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই এ বার সরস্বতী পুজোর চাঁদার জুলুমবাজিতে মারধর ও শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটল। তবে নদিয়ায় চাঁদার জুলুম এই প্রথম নয়। এর আগেও একাধিকবার চাঁদার জন্য মারধর, হুমকি দেওয়ার মতো একাধিক ঘটনার সাক্ষী রয়েছেন জেলার বহু মানুষ। এ বছরেই দুর্গাপুজোর চাঁদার জন্য কৃষ্ণনগরের কাছে গোবরাপোতার স্কুলের শিক্ষকদের বাজারের ভিতরে রাস্তায় ফেলে মারধর কিংবা গাংনাপুর ও চাকদহে কালীপুজোর চাঁদা নিয়ে বাড়িতে ভাঙচুর ও মারধরের ঘটনা আজও মনে রেখেছেন মানুষ।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, কনেযাত্রীদের ওই দুটি বাসে প্রায় একশো জন যাত্রী ছিলেন। অভিযোগ, সাহেবডাঙা গ্রামের ভিতরে রাস্তার পাশে একাধিক সরস্বতী পুজো হলেও স্থানীয় একটি প্রাথমিক স্কুলের কাছেই বাসটিকে থামানো হয়। সেখানকার একটি ক্লাবের বেশ কয়েকজন ছেলে বাসের যাত্রীদের কাছে চাঁদা নিয়ে জুলুমবাজি করে। কনের বাবা হরিপদ বিশ্বাস বলেন, “এর আগে বিয়ের দিন ছেলেকে আশীর্বাদ করতে এসেও আমরা এদেরকে চাঁদা দিয়েছি। এ দিন ফের পাঁচ হাজার টাকা চাঁদার জন্য জুলুম শুরু করে।” তিনি বলেন, “ওরা অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। বাস থেকে নেমে যাঁরা কথা কথা বলার জন্য নিচে নেমেছিলেন তাঁদের উপর ওরা চড়াও হয়। বাধা দিতে গেলে আমাদেরকেও মারধর করা হয়।” বাসের মহিলা যাত্রীদের মারধর ও শ্লীলতাহানি করা হয় বলেও অভিযোগ।
কনেযাত্রীরা জানান, পরিস্থিতি বেগতিক দেখে সকলে বাসের ভিতরে ঢুকে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। তখন ঢিল মেরে বাসের কাচ ভেঙে দেওয়া হয়। কাচের টুকরো ছিটকে বেশ কয়েকজন জখমও হয়েছেন। হরিপদবাবুর ভাইপো শান্তনু বিশ্বাসের অভিযোগ, “জনা কুড়ি-পঁচিশে ওই যুবকদের মধ্যে বেশ কয়েকজন মদ্যপ অবস্থায় ছিল। প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে ওরা তাণ্ডব চালিয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারাও আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি।”
গ্রামবাসীদের পাল্টা অভিযোগ, এটা ঠিক যে, বাসের কাচ ভাঙা হয়েছে। কিন্তু বাকি ঘটনাগুলো অতিরঞ্জিত করে বলা হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দা তথা নবলা গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য তৃণমূলের অমল ঘোষ বলেন, “পুরোটাই বাড়িয়ে বলা হচ্ছে। ছেলেরা চাঁদা চেয়েছিল ঠিকই। কিন্তু ওরা যদি আমাদের গ্রামের ছেলেদের উপরে প্রথমে চড়াও না হত তাহলে এসব কিছুই ঘটত না।”
প্রাক্তন পঞ্চায়েত সদস্য কংগ্রেসের বিকাশ ঘোষ বলেন, “ওই বাসের দু’ একজন নিজেদের পুলিশকর্মী পরিচয় দিয়ে বাজে ব্যবহার করায় উত্তেজনা আরও বেড়ে যায়।” ঘটনার সময় পুলিশের একটি টহলদারি ভ্যান চলে আসায় রণে ভঙ্গ দেয় ওই যুবকরা। এরপর কনেযাত্রীদের পক্ষ থেকে শান্তিপুর থানায় ওই যুবকদের বিরুদ্ধে ভাঙচুর, মারধর, ছিনতাই ও মহিলাদের শ্লীলতাহানির করা হয়েছে বলে একটি মামলা রুজু করা হয়েছে।
কিন্তু একের পর এক রাতের বাসে এমন ঘটনায় উদ্বিগ্ন জেলার বাস মালিকেরাও। নদিয়া জেলা বাস মালিক সমিতির পক্ষে অসীম দত্ত বলেন, “এটা সত্যিই উদ্বেগের। প্রশাসন যাই বলুক না কেন, নদিয়ায় রাতের রাস্তা কতটা নিরাপদ তা নিয়ে প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। আর বাস থামিয়ে চাঁদার জুলুম নদিয়ায় নতুন কিছু নয়। প্রশাসনের উচিত বিষয়টি নিয়ে আরও কড়া পদক্ষেপ করা।” |