পশ্চিমবঙ্গে শিল্প গড়ার পরিবেশ আছে কি না, বিনিয়োগকারীরা সেই বিষয়েই সংশয়ী।
এই সংশয় দূর করার দায় রাজ্য সরকারের। কাজটা সম্ভব, কিন্তু সহজ নয়।
সুপর্ণ পাঠক |
খবরের কাগজ পড়ার একটা আলাদা মজা আছে। পাতা উল্টে শিরোনাম ঝেঁটিয়ে চলতে থাকুন। প্রথম পাতার কোনও খবরই হয়তো আপনার সেই ভাবে মাথায় থাকল না। কিন্তু ভিতরের পাতায় ছোট্ট একটা খবর হঠাত্ আপনার মগজে সিঁধিয়ে গেল। যেমন সে দিন। কাগজ পড়তে পড়তে ভিতরের পাতার এক কোণে ছাপা একটা চটি খবরে চোখ আটকে গিয়েছিল। একটা সমীক্ষা। করেছেন মনোবিদরা। বিষয়টা ছিল ঝুঁকি। বিভিন্ন মানুষের কাছে একই ব্যাপারে ঝুঁকির মূল্যায়ন কেন আলাদা হয়?
সমীক্ষা বলছে, আমরা ঝুঁকি বুঝি দুই ভাবে। এক তো হল সামাজিক অভিজ্ঞতা। যেমন, আমরা সবাই জানি রাস্তার কুকুর কামড়ালে বা আঁচড়ালে অ্যান্টি র্যাবিস ভ্যাকসিন নিতে হয়। ভ্যাকসিনের যন্ত্রণা চতুষ্পদের দাঁতের স্পর্শের থেকে কম নয়, কিন্তু যার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আছে আর যার নেই, এমন দু’জনের মধ্যে ঝুঁকির বোধে তারতম্য থাকবেই। একই সঙ্গে যত মানুষ অ্যান্টি র্যাবিস নেবেন তত তাঁরা ব্যথার কথা বলবেন, আর তাতে ‘কুকুর কামড়ালে এই ভ্যাকসিন নিতে হবে, তাতে খুব ব্যথা, কিন্তু না নিলে মৃত্যু হতে পারে’ এই বোধটাও সামাজিক ভাবে প্রোথিত হতে থাকবে। যিনি না নিয়ে মারা গিয়েছেন তাঁর পরিবারের হা-হুতাশও ঝুঁকির বোধকে তীব্রতর করবে। অর্থাত্ মোদ্দা কথা, অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি ঝুঁকির বোধকে গভীরতর করে তোলে। এটা লগ্নির ক্ষেত্রেও সত্যি। যেমন অসম। |
সম্ভাবনা। মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে বিনিয়োগের প্রাথমিক চুক্তি। মার্চ ২০১৩। ছবি: অমিত দত্ত। |
গণ-আন্দোলনের পর পর ১৯৮৫ সালে প্রফুল্ল মহন্ত যখন মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসেন তখন তাঁর ব্যক্তিগত স্বপ্ন কতটা পরিপূর্ণ হয়েছিল তা তিনিই বলতে পারবেন, কিন্তু অসম রাজ্যের আর্থিক ভবিষ্যত্ ঘিরে যে প্রশ্নচিহ্ন জায়গা করে নিয়েছিল তা মুছতে সময় লেগেছিল একাধিক দশক। সে রাজ্যে প্রফুল্ল মহন্তদের আন্দোলনের কারণে একটা ব্যাপক ধারণা তৈরি হয়েছিল যে, ভিনরাজ্যের মানুষ অসমে ব্রাত্য। এর প্রত্যক্ষ প্রতিফলন হয়েছিল লগ্নিতে। আশি ও নব্বইয়ের দশকে অসমের শিল্পচিত্র ছিল, যোজনা কমিশনের ভাষায়, বিকাশহীন। রাজ্যের বিবর্ণ লগ্নিচিত্রে যে রং ফিরতে পারে, তা অনেক দিন পর্যন্ত, এমনকী এই শতকে গোড়াতেও, কেউই ভাবতে পারেনি। অথচ আজ শিল্পমহলে বিভিন্ন রাজ্যে বিনিয়োগের প্রশ্ন উঠলে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে লগ্নি ডাকলে অনেকেই বলছেন, “তা হলে অসম নয় কেন?”
প্রশ্নটা প্রফুল্ল মহন্তর প্রথম মুখ্যমন্ত্রিত্বের সময় থেকেই উঠতে পারত না কি? তিনি তো গদিতে বসেই অর্থনীতির হাল ফেরাতে ব্যস্ত হয়েছিলেন। বরাভয়েরও অভাব ছিল না। কিন্তু মন ফেরাতে সময় লাগে। কারণ, তত দিনে অসমে ভিনরাজ্যের বাসিন্দাদের নিয়ে মনোভাব ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে সামাজিক অভিজ্ঞতায় পর্যবসিত। হাওয়া যখন একটু ঘুরতে শুরু করেছে, তখনই, ১৯৯০ এপ্রিলে শিল্পপতি সুরিন্দর পল নিহত হন অসমে। আঙুল ওঠে আলফার দিকে। আন্দোলনের কারণে ভয় থেকেই গিয়েছিল। এই হত্যার পরে ভয় আরও ভয়ানক হয়ে ওঠে। এর পর ‘অসম নয় কেন?’ বলার প্রশ্নই ওঠেনি। লগ্নির বাজারে অসমের নাম ফিরতে সিকি শতক লেগেছে।
অসম থেকে পশ্চিমবঙ্গে আসা যাক। অসম নিয়ে লগ্নিপতিদের সংশয় আর পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে তাঁদের সংশয়ের মূল কারণের অবশ্যই ফারাক আছে, কিন্তু মাঝের ক’টা বছরের উদ্দীপনাকে ব্যতিক্রম ধরলে ঝুঁকির নিক্তিতে সেই অসম আর গত কয়েক দশকের পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে মিল আছে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে কারণ অবশ্যই রাজ্যের রাজনৈতিক প্রতিবেশের তৈরি করা সেই তেতো স্বাদ, যার পুনরাবৃত্তি লগ্নির বাজারে এই রাজ্যকে ব্রাত্য থেকে আরও ব্রাত্য করে তুলছে।
বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পরেই বৃহত্ লগ্নিকে অপছন্দের তালিকায় তুলে দেয়। লাইসেন্স রাজের সেই যুগে সরকারি লগ্নির প্রাধান্য ছিল। সরকারি কোষাগারের টাকায় শিল্প টানার সেই যুদ্ধ ছিল এক অর্থে রাজনৈতিক। অনেকটাই কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের সংস্কার পর্বে এসে লগ্নি টানার যুদ্ধটা দাঁড়াল বেসরকারি লগ্নির সঙ্গে প্রেমালাপে। অথচ তত দিনে উত্তাল শ্রমিক আন্দোলন ও বন্ধের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ লগ্নির দুনিয়ায় ব্রাত্য হয়ে গিয়েছে। শুরুতেই উল্লেখ করা মনোবিদদের সমীক্ষার নিয়ম মেনেই।
বেসরকারি লগ্নির প্রতিকূল রাজনীতির খোঁচায় তিন দশকে রাজ্যের বড় শিল্পসংস্থারা প্রায় সবাই সদর দফতর সরিয়ে নিয়ে যায় অন্য রাজ্যে। ব্যাঙ্কগুলো ব্যবসার অভাবে রাজ্য থেকে সরাতে থাকে প্রধান ব্যবসায়িক দফতর। যেমন স্টেট ব্যাঙ্ক সরিয়ে নিয়ে যায় তাদের বিদেশি মুদ্রা লেনদেন কেন্দ্র। আই টি সি-মতো কলকাতার শতাব্দীপ্রাচীন সংস্থাও তাদের নতুন সব ব্যবসার মূল দফতরগুলি খুলতে শুরু করে ভিন রাজ্যে। বিবাহিত জীবন যাপন করতে কে-ই বা জোর করে ঝগড়ুটে সঙ্গী খোঁজে? রাজ্যে বিনিয়োগ নিয়ে নির্দিষ্ট কয়েকটি সংস্থার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা দেশ জুড়েই শিল্পের কাছে সামাজিক অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে। ভিনরাজ্যের কর্মীরা পশ্চিমবঙ্গে নিয়োগকে শাস্তি হিসাবে দেখতে শুরু করে। লগ্নিপতিদের মনে ধর্মঘটের ভয় চেপে বসে।
কিন্তু শিল্প না গড়লে কাজের সুযোগ তৈরি হয় না। কোষাগার ভরতে করের টাকা জোটে না। বাম রাজনীতি নিয়ে শিল্পের ভীতি স্বাভাবিক। সেই ভয় আরও গভীর হয় যখন রাজনৈতিক বিরোধিতা এড়াতেই লগ্নি ভিনরাজ্যমুখী হতে শুরু করে। অথচ সংস্কার-উত্তর ভারতে বেসরকারি মূলধনকে ব্রাত্য করে কোষাগারের টাকার উপর নির্ভর করে বাঁচা তত দিনে রাজনৈতিক বিলাসিতা বলে প্রতিষ্ঠিত। এই সত্য মেনেই ১৯৯৪ সালে বামফ্রন্ট বাধ্য হয় ভোল বদলে লগ্নিমুখী হতে। কিন্তু তত দিনে সংস্থার নিজস্ব অভিজ্ঞতা সামাজিক অভিজ্ঞতায় পর্যবসিত। রাজ্যে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিলেই সংস্থাকে প্রশ্ন শুনতে হত, ‘কেন পশ্চিমবঙ্গ?’ নতুন মুখ যে মুখোশ নয়, বোঝাতে কালঘাম ছুটে গিয়েছিল পূর্বতন সরকারের।
চাকা যখন ঘুরতে শুরু করেছে, এমনই সময় হল রাজনৈতিক পট পরিবর্তন। সাড়ে তিন দশক ধরে এক রাজনীতি শাসন করেছে পশ্চিমবঙ্গকে। তাকে সরিয়ে যখন অন্য এক বিশ্বাস শাসনের পথ তৈরি করতে চায়, তা কখনওই মসৃণ হতে পারে না। সিঙ্গুর-উত্তর পরিবর্তনের পশ্চিমবঙ্গে সাধারণ ভাবে মনে করা হচ্ছিল, শিল্পের জন্য জমি নিয়ে রাজ্য সরকারের ভাবনার জায়গাটাই লগ্নি টানার প্রধান অন্তরায়। কিন্তু আজ তিন বছর পার করে রাজ্য নিয়ে লগ্নিপতিদের সংশয়ের গভীরতর কারণ খোঁজা জরুরি হয়ে উঠছে। বিশেষ করে আজ আর কেবল পশ্চিমবঙ্গ নয়, দেশ জুড়েই শিল্পের জন্য কৃষিজমি অধিগ্রহণ নিয়ে জনমত প্রায় এক খাতে বইছে। তাই প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে কি জমি নীতিই অন্যতম প্রতিবন্ধক নয়?
সম্ভবত নয়। কারণ, শিল্প যে নিজের জমি কিনে কারখানা গড়তে একেবারেই অনিচ্ছুক, তা বলা যাবে না। এ রাজ্যেই অধিগ্রহণ যখন ‘অস্পৃশ্য’ হয়ে যায়নি তখনও শ্যাম স্টিল-এর মতো অনেক সংস্থা নিজের জমির সংস্থান নিজে করেছে। তা হলে? অনেকেই যুক্তি দিচ্ছেন, দেশের বাজার খারাপ, এই অবস্থায় রাজ্যে লগ্নির রমরমা আশা করা অযৌক্তিক। কিন্তু দেশের হাল যতই খারাপ হোক, লগ্নি তো কিছু না কিছু হচ্ছে। অন্ধ্রপ্রদেশে ক’দিন আগেই ইসুজু কারখানা তৈরির কথা ঘোষণা করেছে। তা হলে?
আসলে প্রতিবন্ধক হিসাবে যে ক’টি বড় কারণ রয়েছে তার অন্যতম হল লাল ফিতে। একটা প্রকল্পকে প্রস্তাব থেকে রূপায়ণ পর্যন্ত নিয়ে যেতে এ রাজ্যে যত কাঠখড় পোড়াতে হয়, সেই হ্যাপা আর টানতে রাজি নন লগ্নিপতিরা, বিশেষ করে অন্যান্য রাজ্য যখন এ বিষয়ে অনেক বেশি বিবেচক। এমন নয় যে, বর্তমান সরকার ব্যাপারটা বোঝে না। বোঝে বলেই বণিকসভা এবং মন্ত্রী ও আমলাদের নিয়ে কোর কমিটি হয়েছে, তার ওপর মন্ত্রীদের নিয়ে কমিটি হয়েছে। প্রকল্প নিয়ে সরকারি দফতরগুলোর সঙ্গে সমন্বয় রেখে দ্রুত কাজ শেষ করতে যাতে অসুবিধা না হয়, তা দেখতে প্রকল্প পিছু আমলা নিয়োগের নীতি নেওয়া হয়েছে। তবুও গুমোট কাটছে না।
প্রথমত, প্রতিটি পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েও শিল্প মনে করছে, এই পদক্ষেপগুলি প্রমাণ করছে শিল্প নিয়ে সরকারের দফতরগুলোর মধ্যে বোঝাবুঝির সমস্যা রয়েছে, যা চিরকালীন। না হলে শিল্প নিয়ে এত সমন্বয় কমিটির দরকার হত না। দুই, বামফ্রন্টের শেষ দিকে আসা জিন্দলদের ইস্পাত কারখানার মতো শিল্পপ্রস্তাবগুলি কী ভাবে ছাড়পত্রের রাস্তায় হাঁটছে, সে দিকে তাকিয়ে রয়েছে তারা। নতুন সরকার ক্ষমতায় এসেই যে আশার সঞ্চার করেছিল, সেই উদ্দীপনা কাজে লাগিয়ে প্রশাসন যদি ঝুলে থাকা প্রকল্প নিয়ে দ্রুত ও নির্দিষ্ট রাস্তায় হাঁটত, তা হলেই এই সংশয় মুছে যেত। তা হয়নি। হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালস নিয়েও সমস্যা বেড়েছে বই কমেনি।
এ-রকম নয় যে শিল্প মনে করে, এই সরকার লগ্নি-বিরোধী। কিন্তু নিজের টাকা ঢেলে কেউ এই প্রস্তাবের সত্যতা যাচাই করতে চাইছে না এই বাজারে। এই চাকা উল্টো দিকে ঘোরাতে প্রয়োজন এমন পদক্ষেপ, যা শুরু হওয়া উচিত ঝুলে থাকা প্রকল্পগুলোর ফাইল নিয়ে যুদ্ধকালীন তত্পরতায় সিদ্ধান্ত নিয়ে। কোনও আমলাতান্ত্রিক প্রশ্নচিহ্ন না রেখে। এটা করতে পারলেই রাজ্যে লগ্নি নিয়ে সংশয় ও প্রতিটি প্রকল্পে সেই সংশয়ের পৌনঃপুনিকতা বিনাশের রাস্তায় একটা বিরাট পদক্ষেপ করতে পারবে রাজ্য। যে মুখ্যমন্ত্রী এত প্রথাবিরোধী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে হাঁটছেন, সেই মুখ্যমন্ত্রী শিল্পের ক্ষেত্রে কেন প্রথাগত? এর উত্তরেই কিন্তু লুকিয়ে আছে রাজ্যে লগ্নি নিয়ে ঝুঁকির প্রতিষেধক ভ্যাকসিন। অর্থাত্ প্রয়োজন এমন পদক্ষেপের যা প্রমাণ করবে, রাজ্য নিয়ে লগ্নির প্রথাগত আস্থা-খামতির আর কোনও জায়গা নেই। |