তালিবানরা এখনও কাবুলে ক্ষমতায় ফেরে নাই। কিন্তু আফগান সমাজের তালিবানিকরণ আটকাইতেছে না। যে কয়েকটি অনাচারের জন্য তালিবান শাসন কুখ্যাত, তাহাদের মধ্যে প্রধানতম হইল নারী-নির্যাতন। মহিলাদের উপর যথেচ্ছ অত্যাচার, আপাদমস্তক বোরখার বন্দিত্ব হইতে শুরু করিয়া মহিলাদের বিরুদ্ধে পারিবারিক হিংসা, বাল্যবিবাহ, বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কের অপরাধে প্রকাশ্যে, জনসমক্ষে পাথর ছুঁড়িয়া মারার মতো ‘শাস্তি’র খাঁড়া এই সবই ছিল আফগানিস্তানে তালিবান জমানার বৈশিষ্ট্য। তালিবানের বিদায়ের পর মার্কিন-বহুজাতিক বাহিনীর উপস্থিতি এবং কাবুলে একটি নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের ক্ষমতাসীন হওয়া ক্রমশ আফগান মহিলাদের কিছু অধিকার সুরক্ষিত করিতে সচেষ্ট হয়। তালিবান ধর্মধ্বজীরা আত্মগোপন করিলে মহিলারাও কিছুটা সাহসী হইয়া ওঠেন। আবার নারী-শিক্ষার প্রচলন হয়, জনপ্রতিনিধিসভাগুলিতে মহিলারা নির্বাচিত হইতে শুরু করেন। কিন্তু বহুজাতিক বাহিনীর ঘরে ফেরার নির্ঘণ্ট স্থির হইতেই তালিবানি মৌলবাদ কোটর হইতে বাহির হইয়া আসিয়াছে। ফলে এ বার আফগান মহিলাদের কোটরে প্রবেশের পালা।
ইহারই নমুনা: পারিবারিক হিংসার বিরুদ্ধে অর্থাত্ বাবা-দাদা-ভাই কিংবা অন্য পুরুষ আত্মীয়ের হাতে লাঞ্ছিত, নিগৃহীত, এমনকী ধর্ষিত হওয়ার ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া মেয়েদের লড়াইয়ে ইতি টানিতে সংশ্লিষ্ট আইনের সংশোধন, যাহা অভিযুক্ত পুরুষের বিরুদ্ধে আত্মীয়স্বজনের সাক্ষ্যদানের অধিকার কাড়িয়া লয়। অর্থাত্ অতঃপর কোনও আফগান পুরুষ নির্ভয়ে নিজের স্ত্রী, মা-বোন বা মেয়ের উপর অনাচারে লিপ্ত হইতে পারিবে, প্রতিকারের কোনও আইনি রক্ষাকবচ থাকিবে না। সভ্য সমাজের কাছে রোমহর্ষক এই আইনটি ইতিমধ্যেই আফগান পার্লামেন্টের উচ্চ ও নিম্ন কক্ষে অনুমোদিত। এখন কেবল প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের একটি স্বাক্ষর আফগান নারীর ভাগ্যবিড়ম্বনার উপর রাষ্ট্রীয় সিলমোহর দাগিয়া দিতে যথেষ্ট। আফগান মহিলারা এবং সে দেশের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন তাই প্রমাদ গনিতেছেন। কারণ প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের উপর তাঁহাদের ভরসা নাই। ইতিপূর্বে তিনি এমন কোনও প্রমাণ দেন নাই যাহাতে মনে হইতে পারে যে, তিনি দেশের মহিলাদের মর্যাদা ও অধিকার রক্ষায় ভাবিত। ২০০৯ সালে ‘স্ত্রীকে ধর্ষণ করা পুরুষের অধিকার’এই মর্মে একটি আইন পাশ করা হইতে কারজাইকে নিবৃত্ত হইতে হয় প্রবল আন্দোলনের চাপে। গত পাঁচ বছরে মহিলাদের অধিকার কাড়িয়া লওয়ার একের পর এক আইন কারজাই পাশ হইতে দিয়াছেন। এ বারও যে তিনি বাধা হইয়া দাঁড়াইবেন না, তাহা নিশ্চিত।
প্রেসিডেন্ট কারজাই কাবুলে নিজের ক্ষমতা ধরিয়া রাখিতে তালিবানের সহিত রাজনৈতিক বোঝাপড়ায় ব্যগ্র। এই বোঝাপড়ার যেমন একটা রাজনৈতিক দিক আছে, তেমনই আছে একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক দিকও। সেখানে গোঁড়া সুন্নি সম্প্রদায়ের কঠোর শরিয়তি নিদান মানিয়া আফগান মহিলাদের সব ধরনের অধিকার হরণের প্রয়োজনীয়তা আছে। কারজাই যত দিন মার্কিন বদান্যতায় ক্ষমতাসীন ছিলেন, তত দিন পাশ্চাত্য উদারনীতির সহিত কাবুলের শাসননীতিকে মিশাইবার ছল করিতেন। এখন তাঁহাকে তালিবান প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনার সহিত খাপ খাওয়াইতে হইতেছে, মহিলাদের স্বাধীনতা কাড়িয়া লইতে কট্টর ইসলামপন্থী হইতে তাঁহার বাধা কোথায়? |