পশ্চিমবঙ্গবাসীর দুই হাতে দুইটি লাড্ডু তুলিয়া দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি নরেন্দ্র মোদীর ভাষণে পাওয়া গেল, তাহা বিজেপি-র প্রধানমন্ত্রী-পদপ্রার্থীর চরিত্রানুগ বলিলে অনৃতভাষণ হইবে। গত কয়েক মাস ভারত যে নরেন্দ্র মোদীকে দেখিয়াছে, তিনি আক্রমণাত্মক। তাঁহার ভাষণে তথ্যগত ভ্রান্তি থাকিতে পারে, কিন্তু কোনও রাজ্যের অ-বিজেপি শাসকের প্রতি নমনীয়তা এই কয়েক মাসে দেখা যায় নাই। ব্রিগেডের সমাবেশ ব্যতিক্রমী হইল। অনুমান করা চলে, মোদী স্বেচ্ছায় এই প্রায়-মৈত্রীর পথ বাছেন নাই, দলীয় উপদেষ্টাদের পরামর্শে তাঁহার সুর বদলাইয়াছে। ইউপিএ সরকারের শরিক থাকাকালীন এবং তাহার পরবর্তী সময়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে দাবিগুলি কেন্দ্র মানে নাই, মোদী কার্যত তাহার সব কয়টি পূরণ করিবার আশ্বাস দিয়াছেন। মোদীর মৈত্রী-বার্তা অবশ্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অস্বস্তির কারণ হইল। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সমীকরণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে বিজেপি এবং বিশেষত নরেন্দ্র মোদীর ঘনিষ্ঠ হওয়া মুশকিল। মুসলমান সমাজের মধ্যে আপাতত তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতি সমর্থন যথেষ্ট। মোদী তাঁহাদের পছন্দের রাজনীতিক নহেন। কাজেই, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহিত নরেন্দ্র মোদীর কোনও সংযোগ সাধিত হইতে পারে, এমন বার্তা তাঁহাদের উদ্বিগ্ন করিবে এবং সেই উদ্বেগের ছাপ ব্যালট বাক্সে পড়িবার সম্ভাবনা প্রবল। শুধু লোকসভা নির্বাচনই নহে, ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনও আর খুব দূরে নহে। তাঁহাকে বিব্রত করিবার এই সুবর্ণ সুযোগটি স্বভাবতই বিরোধীরা ছাড়িতেছেন না।
মুসলমান ভোটব্যাঙ্কের চোখে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাবমূর্তি মলিন হইলে সর্বাধিক লাভ কংগ্রেসের। তাহার দুইটি কারণ। এক, গ্রামবাংলায় বামপন্থীদের সাইনবোর্ডটুকুও অনেক ক্ষেত্রে অবশিষ্ট নাই। দুই, নরেন্দ্র মোদীর উগ্র হিন্দুত্বের প্রধানতম প্রতিস্পর্ধী হিসাবে এখনও কংগ্রেসই স্বীকৃত। অতএব, মোদীর ভাষণে ২৪ আকবর রোডে হাসি ফুটিতেই পারে। পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের ভবিষ্যত্ যে তৃণমূলের সঙ্গে জোটের উপর নির্ভরশীল, তাহা প্রশ্নাতীত। কিন্তু তৃণমূলও, তাহাদের যাবতীয় হুঙ্কার সত্ত্বেও, জোট ছাড়া খানিক মুশকিলে পড়িবে। ব্রিগেডের জনসভায় স্পষ্ট, এই রাজ্যে বিজেপি-র প্রভাব বাড়িতেছে। লোকসভা ভোটে তাহাদের ভোটও বাড়িবে। ৪২টি আসনের একটিতেও বিজেপি জয়ী হইবে কি না, তাহা ভিন্ন প্রশ্ন, কিন্তু বহু আসনের সমীকরণই তাহারা বদলাইয়া দিতে পারে। সেই বদল তৃণমূলের অনুকূলে নহে। কংগ্রেসের সহিত জোট হইলে তৃণমূলের পক্ষে এই লড়াইয়ে সুবিধা অনস্বীকার্য। নরেন্দ্র মোদীর ভাষণ তৃণমূল নেত্রীকে সেই জোটের পথে এক কদম আগাইয়া দিলে আশ্চর্য হইবার কারণ থাকিবে না।
ব্রিগেডের ভাষণে তিনি যাহাই বলুন, পশ্চিমবঙ্গ লইয়া নরেন্দ্র মোদীর বিশেষ শিরঃপীড়া আছে, এমন ভাবিবার কোনও কারণ নাই। তাঁহার পাখির চোখ দিল্লির মসনদ। তাঁহার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দুইটি (পরস্পর-সম্পর্কিত) শর্ত বিজেপির বেশি আসন লাভ ও কংগ্রেসের ভরাডুবি। পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস-তৃণমূল জোট হইলে প্রথম শর্তটিতে কোনও প্রভাব পড়িবে না, কিন্তু দ্বিতীয়টি লঙ্ঘিত হইবে। জোট হইলে এই রাজ্যে কংগ্রেস কিছু আসনে জিতিবে বলিয়া অনুমান করা চলে। তাহার সহিত যুক্ত হইবে তৃণমূল কংগ্রেসের আসনগুলি। অনুমান, এই একটি জোট ইউপিএ-র ঝুলিতে ৩০ বা ততোধিক আসন বাড়াইয়া দিতে পারে। বস্তুত, মোদীর প্রধানমন্ত্রিত্বের স্বপ্নের পথে বৃহত্তম বাধা হইতে পারে এই জোট। তাঁহার (স্বভাববিরোধী) ভাষণ এই জোটের পক্ষে অনুঘটকের কাজ করিল, এই সত্যটি নরেন্দ্র মোদীর পক্ষে প্রতিকূল হইতে পারে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য দরজা খোলা রাখিতে গিয়া তিনি আপনার যাত্রা কঠিনতর করিলেন না তো? |