মুক্ত মনের সেই আচার্যকে কুর্নিশ
ঋজু বসু • কলকাতা |
নিজে মঞ্চে উঠতেন কালে-ভদ্রে। কিন্তু তাঁর শিষ্যেরা শাসন করছেন সঙ্গীত-ভুবন।
তবলা, পাখোয়াজ, ঢোল, খোল, নাগাড়ায় দৃপ্ত চলাফেরা তাঁর। হারমোনিয়ম থেকে পিয়ানো, অর্গ্যান, বেহালা, গিটার, ক্ল্যারিওনেট, কর্নেট, হার্পেও তুখোড়। কিন্তু মঞ্চে তাঁকে বাজাতে শুনেছেন গুটিকয় ভাগ্যবান।
তিনি আচার্য জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ। অগুন্তি ভজন, ঠুংরি, খেয়াল, গীতের স্রষ্টা। যাবতীয় আহরণ অকাতরে বিলিয়েই যেন তাঁর সার্থকতা।
সঙ্গীতজগতের এই পুরোধার শতবর্ষে কলকাতায় মিলছে দেশের সঙ্গীত-সমাজ। উদ্যোক্তা অজয় চক্রবর্তীর সংস্থা শ্রুতিনন্দন। আজ, শুক্রবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যেপাধ্যায়ের হাতে সূচনা ‘রিদ্ম ফেস্টিভ্যাল’-এর। রবিবার সঙ্গীতের মহাভোজ, নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে। |
ষাটের দশকে বেতারে জ্ঞানপ্রকাশের ‘রম্যগীতি’ সঙ্গীতের যাবতীয় আঙ্গিকের কথা তুলে ধরত। দেশে-বিদেশে যেখানে যেতেন গোগ্রাসে খুঁজতেন নতুন স্বর-সুর। আকৈশোর জ্ঞানবাবুর শিষ্য অজয়বাবুর মতে, “স্রেফ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের গণ্ডিতে বেঁধে রাখলে গুরুজির মূল্যায়ন হবে না।” গুরুপ্রণামের আসরও বৈচিত্র্যে ভরপুর। সন্তুর বিশারদ শিবকুমার শর্মা বা তালবাদ্যে জাকির হুসেন, সুরেশ তলওয়ালকর, তওফিক কুরেশিরা তো আছেনই, বাদ পড়েনি বলিউডের জনপ্রিয় কণ্ঠও। কৌশিকী চক্রবর্তী ও বলিউডের তরুণ রক্ত অরিজিৎ সিংহকে নিয়ে কিছু উপস্থাপনার ভাবনা তবলা-শিল্পী বিক্রম ঘোষের। বলছেন, “গুরুজি শুধু একটা বিস্ময়-প্রতিভা নন! আজও সমান প্রাসঙ্গিক।”
এমন গুরুর দেখা পাওয়া এ যুগে ভার, মানছেন সবাই।
জ্ঞানবাবুর শিষ্য তথা পুত্র তবলা-শিল্পী মল্লার ঘোষের কথায়, “বাবার এত সাধনা-শিক্ষার সবটাই পরের প্রজন্মের কথা ভেবে।” যৌবনের বেশির ভাগটা জুড়ে শুধু সংগ্রহ করেছেন, মহার্ঘ সব গৎ কিংবা হিন্দুস্থানি সঙ্গীতের গায়কী। এক কথায় কখনও খুলে দিয়েছেন হিরের বোতাম কি দামি কাশ্মীরি শাল! যা পেয়েছেন, সঙ্গে-সঙ্গে শিষ্যদের না-শিখিয়ে শান্তি নেই! তবলায় শঙ্কর ঘোষ, কানাই দত্ত, শ্যামল বসু, অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় বা গানে প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, অজয় চক্রবর্তী— কয়েক প্রজন্ম জুড়ে এতটাই কুলীন এই শিষ্য-তালিকা।
প্রবীণ সরোদিয়া বুদ্ধদেব দাশগুপ্তও নিজেকে জ্ঞানবাবুর শিষ্য মনে করেন। বলছেন, ওঁর কাছে গান শেখার অভিজ্ঞতা আমার যন্ত্রসঙ্গীতকে পুষ্ট করেছে। জ্ঞানপ্রকাশের সুর-গায়কীতে সুকুমার রায়ের ‘রোদে রাঙা ইঁটের পাঁজা’-য় এখনও মশগুল কবীর সুমন। শতবর্ষেও এই খোলা মনের গুরুর ছায়া দীর্ঘতর হচ্ছে। |