লাভপুর গণনির্যাতন-কাণ্ডে আদিবাসী তরুণীকে বেঁধে রেখে সালিশিসভা ডাকা হয়েছিল। সেই সভা তরুণীর জরিমানাও ধার্য করেছিল। বৃহস্পতিবার বোলপুরের এসিজেএম পীযূষ ঘোষের এজলাসে এ কথা স্বীকার করে নিলেন খোদ অভিযুক্ত পক্ষের আইনজীবী দিলীপ ঘোষ। গণধর্ষণের অভিযোগ অস্বীকার করার পাশাপাশি তিনি যুক্তি দিলেন, আদিবাসী সমাজকে ‘কলুষিত’ হওয়ার থেকে বাঁচাতেই এমনটা করা হয়েছিল।
এ দিনই দিলীপবাবু অভিযুক্তদের জামিনের আবেদন করলে বিচারক তা নামঞ্জুর করে ১৪ দিন জেল হাজতে রাখার নির্দেশ দেন। তিনি বিচারকের কাছে একটি পৃথক আর্জিও জানান। তাতে দিলীপবাবু ওই মামলার সঙ্গে যুক্ত যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা কোনও কেন্দ্রীয় সংস্থাকে দিয়ে করানোর অনুরোধ করেন। সরকারি আইনজীবী ফিরোজকুমার পাল বলেন, “জামিনের আর্জি খারিজ করে বিচারক ধৃতদের আগামী ২০ ফেব্রুয়ারি ফের আদালতে হাজির করানোর নির্দেশ দিয়েছেন। মামলা সংক্রান্ত পরীক্ষাগুলি কেন্দ্রীয় সংস্থাকে দিয়ে করানোর অভিযুক্ত পক্ষের আইনজীবীর আর্জির শুনানিও ওই দিনই হবে। এ দিন মামলার তদন্তকারী অফিসার ডিএসপি পার্থ ঘোষ ৩৩০ পাতার কেস ডায়েরিও জমা দিয়েছেন।” এ দিকে দিলীপবাবু নির্যাতিতার ডাক্তারি পরীক্ষার রিপোর্ট দেখানোরও আর্জি জানান। যদিও বিচারক এখনই তা অভিযুক্ত পক্ষের আইনজীবীকে দেখাতে অসম্মত হন।
এ দিন দুপুরে পুলিশ অভিযুক্তদের তিনটি গাড়িতে চাপিয়ে বোলপুর আদালত চত্বরে নিয়ে আসে। আড়াইটের পরে মামলাটি ওঠে এসিজেএমের এজলাসে। শুরু থেকেই সেখানে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। প্রথমেই বিচারক দিলীপবাবুকে মামলা সম্পর্কে নিজের বক্তব্য পেশ করতে বলেন। দিলীপবাবু জানান, গণধর্ষণের মতো অতি স্পর্শকাতর মামলায় তাঁর মক্কেলদের ফাঁসানো হয়েছে। প্রত্যেকেই ষড়যন্ত্রের শিকার। অভিযুক্ত পক্ষের আইনজীবী দাবি করেন, গ্রামবাসীরা ওই তরুণীকে বারবার সতর্ক করেছিলেন। ঘটনার দিন তরুণী আর তাঁর সঙ্গীকে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় ধরে গ্রাম ও সমাজকে ‘কলুষিত’ হওয়ার থেকে বাঁচাতে দু’জনকে বেঁধে রাখা হয়েছিল বলেও তিনি জানান। এরপরে তাঁর আরও স্বীকারোক্তি, পুলিশকে না জানিয়ে তাঁদের বেঁধে রেখে জরিমানা করা হয়েছে, এটা দেশের আইনের মধ্যে পড়ে না। এটা অন্যায়। যদিও তাঁর অভিযোগ, অন্য কারও অঙ্গুলিহেলনেই ঘটনাটি ঘটেছে। নিরপেক্ষ তদন্ত হলেই তা বেরিয়ে আসবে। এরপরেই গণধর্ষণের অভিযোগকে ভিত্তিহীন জানিয়ে তিনি বিচারকের কাছে ধৃতদের জামিনের আবেদন করেন। একই সঙ্গে তিনি জানান, তাঁর মক্কেলদের রাজ্য সরকারের কোনও সংস্থার উপরে ভরসা নেই। তাই ওই মামলার সঙ্গে যুক্ত যাবতীয় পরীক্ষা কোনও কেন্দ্রীয় সংস্থাকে দিয়ে করানোর আর্জি তিনি বিচারকের কাছে রাখেন। পাশাপাশি দিলীপবাবু নির্যাতিতা তরুণীর মেডিক্যাল রিপোর্ট দেখতে দেওয়ার আর্জিও জানান। বিচারক অবশ্য জানিয়ে দেন, তদন্তের এই পর্যায়ে ওই রিপোর্ট দেখানো যাবে না।
এরপরেই বলতে ওঠেন সরকারি আইনজীবী ফিরোজকুমার পাল। তিনি প্রথমেই জানান, দিলীপবাবু ‘আপত্তিকর মন্তব্য’ করেছেন। মামলায় এ যাবত যা তথ্য প্রমাণ রয়েছে, তাতে গণধর্ষণের ঘটনা স্পষ্ট। তিনি অভিযুক্তদের জামিনের আর্জির তীব্র বিরোধিতা করেন। সেই সঙ্গে তিনি জানান, মামলায় তরুণীর মেডিক্যাল রিপোর্ট, একাধিক ব্যক্তির গোপন জবানবন্দি-সহ আদালতে ৩৩০ পাতার কেস ডায়েরি জমা দেওয়া হয়েছে। ধৃতদের ‘টিআই প্যারেডে’র জন্য তদন্তকারী অফিসারের আর্জিও রয়েছে। এরপরেই বিচারক তাঁর কাছ থেকে ওই সম্বন্ধে কিছু খুঁটিনাটি জেনে নেন। সামান্য পরে তিনি চাপা গলায় সরকারি আইনজীবীকে আগামী দু’দিনের মধ্যে ‘টিআই প্যারেডে’র আর্জি জানাতে বলেন। তিনটে নাগাদ বিচারক জামিনের আর্জি নামঞ্জুর করে ধৃতদের ১৪ দিন জেল হাজতে রাখার নির্দেশ দেন। সমস্ত পরীক্ষা কেন্দ্রীয় সংস্থাকে দিয়ে করানোর আর্জির শুনানির জন্য আগামী ২০ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করেন। ওই দিন ফের অভিযুক্তদের আদালতে হাজির করানো হবে। গত ২২ জানুয়ারি ওই তরুণী ১৩ জনের বিরুদ্ধে গণধর্ষণের অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। |