বন উন্নয়ন নিগমের গড়পঞ্চকোটের প্রকৃতি ভ্রমণ কেন্দ্র ব্যবসার নিরিখে রাজ্যের মধ্যে সেরার শিরোপা পেয়েছে। আর সেই পুরুলিয়া জেলার জঙ্গলমহলেই নিগমের দুয়ারসিনি পর্যটন কেন্দ্র টানা তিন বছর ধরে কিছু মাত্র ব্যবসা না করতে পারার নজির রাখল। কারণ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সেই আগের মতোই মোহময় থাকলেও মাওবাদীরা এই অতিথি আবাস পুড়িয়ে দেওয়ার পরে গত সাড়ে তিন বছরে তা আর সংস্কার করা হয়নি। তাই এখানে থাকার সাধ নিয়ে ঘুরতে আসা পর্যটকেরা পর্যটন আবাসের হানাবাড়ির চেহারা দেখে এখন হতাশ হয়ে অন্যত্র ফিরে যাচ্ছেন।
২০১২-’১৩ আর্থিক বছরে বেশি প্রচারের আলোয় থাকা রাজ্য বন উন্নয়ন নিগমের পর্যটনকেন্দ্রগুলি অপেক্ষা গড়পঞ্চকোটের বনবাংলোগুলি সব থেকে বেশি পর্যটক টেনেছে। যার জেরে এখানে ৬২ লক্ষ টাকার ব্যবসা হয়েছে। তা সত্ত্বেও এক সময়ে পর্যটকদের চোখের মণি হয়ে থাকা বান্দোয়ানের দুয়ারসিনিকে কেন রাজ্য বন উন্নয়ন নিগম জঙ্গলমহল শান্ত হওয়ার পরেও দুয়োরানি করে রেখেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে নানা মহলে।
দুয়ারসিনির নৈসর্গিক সৌন্দর্যকে গুরুত্ব দিয়ে ২০০১ সালে বন উন্নয়ন নিগম দুয়ারসিনি প্রকৃতি ভ্রমণ কেন্দ্রে ৩টি বনবাংলো তৈরি করেছিল। বন দফতরের কর্তাদের কথায়, শুধুমাত্র শীতের মরসুমেই নয়, গ্রীষ্ম-বর্ষাকালেও পর্যটকরা দুয়ারসিনিতে ভিড় করতেন। বাসিন্দাদের দাবি, ঋতু বদলের সঙ্গে সঙ্গে দুয়ারসিনিতে প্রকৃতির রঙও বদলায়। এক দিকে ঝাড়খণ্ডের সুবিশাল জঙ্গলাবৃত পাহাড়, অন্য দিকে খরস্রোতা সাতগুড়ুম নদী জঙ্গলকে সাতবার পাক খেয়ে গিয়েছে। তাই এখানকার প্রাকৃতিক রূপ প্রকৃতিপ্রেমীরা এড়াতে পারতেন না। |
২০১০ সালের মাঝামাঝি থেকে সেই ছবিটাই বদলে গেল। বান্দোয়ানের কুচিয়ার রেঞ্জ আধিকারিক লগনচন্দ্র মুদি ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে এখানে আসেন। তাঁর স্মৃতিতে এখনও তাজা সে দিনের ঘটনা। তিনি বলেন, “২০১০ সালের মাঝামাঝি সময়ে এক রাতে খবর পাই দুয়ারসিনির তিনটি বন বাংলো দাউদাউ করে জ্বলছে। অভিযোগের তির ছিল মাওবাদীদের দিকে। রাতে আর সাহস করে বের হতে পারিনি। সকালে গিয়ে দেখি সব শেষ।” এক বনকর্মীর সংযোজন,আগে থেকেই এলাকায় মাওবাদীদের আনাগোনা ছিল। ২০০৫ সালে অনগ্রসরশ্রেণি কল্যাণ দফতরের তৈরি করা একটি দোতলার অতিথি আবাস পুলিশের শিবির হতে পারে আশঙ্কা করে মাওবাদীরা ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দেয়। তা সত্ত্বেও নিগমের এই বাংলোয়া পর্যটকদের আসা বন্ধ হয়নি। এখন জঙ্গল অনেক শান্ত। পর্যটকরা অনেকেই বন বাংলোয় থাকার জন্য আসেন। ফোনও করেন। কিন্তু তাঁরা থাকবেন কোথায়? ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাঁদের আক্ষেপ, মাঝে মধ্যে বন দফতরের কর্তারা আসেন। কিন্তু দুয়ারসিনি বনবাংলোর সংস্কার আর হয়নি।
এক সময়ে এই বনবাংলোয় আতিথেয়তার প্রায় সবরকম সুবিধা ছিল। একদিনের জন্য মাথা পিছু ৫০০ টাকা চার্জ নেওয়া হত। পরিচ্ছন্ন ঘর, জেনারেটরের আলো, পোকামাকড় আটকাতে জানালায় জাল, বাথরুমে শাওয়ার থেকে কমোড ইত্যাদি ছিল। দেখভালের অভাবে একে একে সব উধাও। খাওয়ার খরচ আলাদা। বন রক্ষা কমিটির সদস্যেরা পালা করে রান্নার দায়িত্ব নিতেন। গরম ভাতের সঙ্গে কপাল ভালো থাকলে পাতে পড়ত বন মোরগের মাংস। সামনের চত্বরে জোৎস্না রাতে সাঁওতালি নাচের আসর বসত। স্থানীয় মেয়েদের হাতে তৈরি খেজুর পাতার টুপি, বাঁশি পর্যটকরা নিয়ে যেতেন।
পুরুলিয়া স্টেশন থেকে ভায়া বরাবাজার হয়ে বান্দোয়ানের দুয়ারসিনির দূরত্ব ৮২ কিলোমিটার। টাটা হয়ে গালুডি স্টেশনে নামলে ছোট গাড়িতেও আসা যায়। গালুডি থেকে দূরত্ব ১৫ কিলোমিটার। লাগোয়া রাজগ্রামের বাসিন্দা ভীম সিং এখন বান্দোয়ান পঞ্চায়েত সমিতির বন ও ভূমি কর্মাধক্ষ্য হয়েছেন। তিনি বলেন “দুয়ারসিনির বনবাংলোয় জায়গা না পেয়ে পর্যটকদের তাঁবু খাটিয়ে থাকতে দেখেছি। কী ভাবে ফের বনবাংলোগুলি সাজানো যায়, সেই চেষ্টা করছি।”
বন উন্নয়ণ নিগমের খড়গপুর ডিভিশনের জেনারেল ম্যানেজার মিলন মণ্ডল বলেন, “আমি দুয়ারসিনি বনবাংলোগুলি দেখে এসেছি। সংস্কারের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তবে এলাকার জনপ্রতিনিধিরা নিগমকে চিঠি দিলে সেই কাজ আরও গতি পাবে।” বান্দোয়ানের বিধায়ক সুশান্ত বেসরা দাবি করেছেন, ইতিমধ্যেই তিনি এ ব্যাপারে বিধানসভায় আর্জি জানিয়েছেন। বান্দোয়ান পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সন্ধ্যারানি সহিস বলেন, “দুয়ারসিনি পর্যটন কেন্দ্র ফের যাতে চালু করা যায়, সে জন্য সবরকম চেষ্টা করব।” কবে ফের বনবাংলো চত্বরে আদিবাসী মাদল বেজে ওঠে, সেই অপেক্ষায় তাকিয়ে বাসিন্দারা। একই অপেক্ষায় পর্যটকেরাও। |