প্রবন্ধ ২...
ছেলেমেয়েরা কী শিখছে, সেটা জানা জরুরি
লেখাপড়া শেখায় এত উত্‌সাহ আমরা পাইনি, এখন মেয়েরা সাইকেলে চড়ে পড়তে আসছে। বললেন তোতা সাঁতরা। ঝাড়গ্রামের স্বাস্থ্যকর্মী। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মেলবন্ধনে নিবেদিত এই মানুষটি কিছু দিন আগে প্রতীচী ট্রাস্ট আয়োজিত এক আলোচনাসভায় এ ভাবেই জানালেন মনের কথা। শান্তিনিকেতনে শিক্ষক প্রশিক্ষক কেন্দ্র বনিয়াদের মাঠে শীতের রোদমাখা দিনে আলোচনার বিষয় ছিল শিক্ষার গুণগত মান: ধারণা ও বাস্তবতা। এ রাজ্যে প্রাথমিক শিক্ষার চেহারাটা নিয়ে যে-সমস্ত উদ্বেগ চার দিকে, তার একটা প্রধান হল শিক্ষার গুণগত মান। আলোচনায় এ কথা উঠে এসেছে যে, রাজ্যে প্রাথমিক শিক্ষায় পরিকাঠামো এবং আনুষঙ্গিক কিছু উন্নয়নের কল্যাণে শিক্ষক-অভিভাবকদের মধ্যে ভরসা জেগেছে, স্কুলমুখী হয়েছে শিশুরা, মিড-ডে মিলের সহায়তায় ভরা পেটে লেখাপড়ার সুযোগ মিলছে, বিশেষ ভাবে বেড়েছে ছাত্রীসংখ্যা। তবু একটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। শিক্ষার গুণগত মান বলতে ঠিক কী বোঝায়, ঠিক কী ভাবে তাকে মাপা যেতে পারে, এই নিয়ে সমাজে বিভিন্ন অবস্থান আছে, যার সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কিত ধারণা শিক্ষা মানুষ হওয়ার জন্য, না কি নম্বর পেয়ে চাকরি পাওয়ার জন্য। এ বিতর্ক থাকবে। কিন্তু ন্যূনতম একটি মান নিশ্চিত হওয়া দরকার। সে সম্পর্কে কোনও তর্ক নেই। যা হল, পড়তে লিখতে ও সাধারণ অঙ্ক করতে শেখা। দেখা যাচ্ছে, সেই মূল জায়গাতেই ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।
আলোচনাসভায় শিক্ষক-শিক্ষিকা, শিক্ষাকর্মী, অভিভাবক, আধিকারিক, গবেষক, সবাই মিলে একটা সমাধান খোঁজার চেষ্টা হল। ইদানীং শিক্ষার গুণমানের ঘাটতি নিয়ে কথা হলেই এক দল এ ব্যাপারে ‘পাশ-ফেল’ ব্যবস্থা তুলে দেওয়াকেই কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন। যেন ‘পাশ-ফেল’ চালু করলেই গুণমান আকাশ ছোঁবে। এই বিতর্কে শিখে ওঠার যাবতীয় দায়দায়িত্ব বেচারি শিশুটির ঘাড়ে গিয়েই পড়ে চিন্তাভাবনার এই দিকটিকে অধ্যাপক অমর্ত্য সেন ‘স্থূলতা’ বলেছেন। আশার কথা এই যে, আলোচনাসভায় দেখা গেল, সমবেত শিক্ষকমণ্ডলী তার থেকে অনেকাংশেই মুক্ত। বরং তথাকথিত পিছিয়ে পড়া ছাত্রছাত্রীকে কী ভাবে মূল স্তরে আনা যায়, তার প্রচেষ্টার কথাই বলছিলেন তাঁরা।
পথ খুঁজতে গিয়ে শিক্ষক-অভিভাবক-আধিকারিক সকলের মধ্যে একটা আন্তরিক সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা প্রায় সকলেই অনুভব করেছেন। মুর্শিদাবাদের শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অমিয় সরকার যেমন বেদনার সঙ্গে বলেন যে, তাঁদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে একটা বড় অংশের শিক্ষক-শিক্ষিকা কেবলমাত্র সার্টিফিকেট নিতে আসেন। অন্য এক শিক্ষকের কাছ থেকে শোনা গেল, উত্‌কর্ষ অভিযানে স্কুলে আগত আধিকারিকরা স্কুলের কাগজপত্র আর মিড-ডে মিলের হিসাব ঠিক থাকলেই খুশি, লেখাপড়ার মান নিয়ে তাঁদের কোনও মাথাব্যথা নেই। আবার, এই চরম অবহেলার মধ্যেই নিজেদের কাজটুকু দিনে দিনে সমৃদ্ধ করে চলেছেন বহু শিক্ষক। উত্তর ২৪ পরগনার স্বরূপনগর থেকে আসা শিক্ষকদের নিজেদের তৈরি শিক্ষা-সহায়ক উপকরণ ও পঠনপাঠন পদ্ধতি সকলকে অভিভূত করল। শিক্ষক ও আধিকারিকের সহযোগিতা আরও স্পষ্ট হল জেলার প্রাথমিক শিক্ষক সংসদের চেয়ারপার্সন মীনা ঘোষের উপস্থিতিতে। যাঁর বক্তব্যে উঠে এল শিক্ষকদের প্রতি তাঁর সম্মান ও জেলার শিক্ষা বিকাশে তাঁর আগ্রহ। বাঁকুড়ার অশোক মুখোপাধ্যায়ের মতেও, আধিকারিকের বিদ্যালয় প্রদর্শন খবরদারির জন্য নয়, বরং হওয়া উচিত সহযোগিতা-সহায়তার ভূমিকায়।
গুণগত মান যাচাইয়ে মূল্যায়নের প্রসঙ্গ আসবেই। বর্তমানে যে নিরবচ্ছিন্ন সার্বিক মূল্যায়ন চালু হয়েছে, উপযুক্ত অভিমুখীকরণ না হওয়ায় শিক্ষকদের অনেকেই এ নিয়ে ধোঁয়াশায় আছেন। অবস্থা এমন দাঁড়াচ্ছে যে, এই মূল্যায়ন ব্যবস্থা ভাল ভাবে চালু হওয়ার আগেই বর্জনের প্রসঙ্গ উঠছে। একটি শিশুকে তার না-শিখতে পারার জন্য এক জায়গায় আটকে রাখা যেমন ঠিক নয়, তেমনই কোনও কিছু না শিখিয়ে পরের স্তরে তুলে দেওয়াও ঠিক নয়। বরং তার সাফল্য-ব্যর্থতাগুলোকে সামগ্রিক ভাবে চিহ্নিত করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। এ কাজটা সবচেয়ে ভাল ভাবে করতে পারেন বিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ। কিন্তু নিরপেক্ষ বাস্তবমুখী বহির্মূল্যায়নেরও প্রয়োজন আছে, যেখানে অভিভাবকেরাও যোগ দিতে পারেন। অমর্ত্য সেন বিষয়টিকে স্পষ্ট করে বললেন: পাশ ফেল-এর সঙ্গে পরীক্ষাকে যুক্ত করলে চিন্তার ভ্রান্তি উত্‌পন্ন হয়। পরীক্ষা না থাকলে ছাত্রের প্রগতি কী ভাবে নির্ধারণ হবে? কত নম্বর পেল, সেটা নিয়ে লজ্জিত হওয়ার কিছু নেই, কিন্তু এটা জানা জরুরি যে, সে কতটা কী পারছে।
সভায় যে বিষয়টি উঠে আসছিল, তা এই যে, শিক্ষা ক্ষেত্রে নানান পরীক্ষানিরীক্ষা, পাঠ্যবইয়ের হেরফের, নানান পরিবর্তন ও বিবিধ প্রতিকূলতার মধ্যেও বেশ কিছু শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী, অভিভাবক সরকারি প্রাথমিক শিক্ষাকে শক্ত জমিতে দাঁড় করানোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বেসরকারিকরণের ঝোঁক যেমনই থাক, এ রাজ্য তথা দেশের অধিকাংশ মানুষের কাছেই শিক্ষার অন্দরে ঢোকার একমাত্র মাধ্যম সরকারি ব্যবস্থা।
সভায় উপস্থিত নবনীতা দেবসেন যখন মনে করিয়ে দেন যে, শিক্ষা স্বপ্ন দেখতে শেখায়, সাহস জোগায় স্বপ্নকে সাকার করার। এই প্রত্যয়ও উঠে আসে যে, এই শিক্ষার জন্য মাস্টারমশাইরা আছেন। আছেন বর্ধমানের মুনালি-র মতো শিক্ষিকা, যিনি লক্ষ করেছেন, ক্লাসে মেয়েদের গুণগত মান বেশি। কিংবা রফিকুল, যিনি নিজের স্কুলে হাতেকলমে শিক্ষার প্রয়াস চালাচ্ছেন। অথবা বিভাস, যিনি বলছেন, গোটা বিদ্যালয় পরিসরকেই কী ভাবে শিক্ষা-সহায়ক করে তোলা যায়। আলোচনার মাধ্যমেই এই স্বপ্নগুলি মিলতে পারে, পরস্পরকে সমৃদ্ধ করতে পারে। শিক্ষা একটি সামাজিক আন্দোলন যে পথ ধরেই আজ প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়েরা সাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসছে। এক বন্ধুর স্মৃতিচারণায় জানা গেল, সেই অঞ্চলে তাঁর কম বয়সে একটি মেয়ে সাইকেল চালানোয়, তাকে দেখতে মেলা লেগে গিয়েছিল। আশা করতে ভরসা হয়, সর্বজনীন শিক্ষার হাত ধরে এই নিঃশব্দ বিপ্লব আগামী দিনে গোটা সমাজকেই নতুন আলো দেখাবে।

ব্রাহ্মণখণ্ড বাসাপাড়া উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.