প্রবন্ধ ১...
ফুলগুলো সব কোথায় চলে গেল
খন ভিয়েতনাম যুদ্ধ চলছে। আমেরিকায় একটি অনুষ্ঠানে পিট সিগার গান গাইছেন। অনুষ্ঠান শেষে গ্রিন রুমে এক অচেনা যুবক এসে দেখা করেন। তিনি বলেন, ‘মিস্টার সিগার, আমি আজ আপনাকে খুন করতে এসেছি’! হতভম্ব ভাবটা কাটার পর পিট পুলিশ না ডেকে সেই যুবকের সঙ্গে কথা বলতে বসেন। জানতে পারেন তাঁর পরিচয়। আমেরিকার এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে তাঁর বাড়ি। কিছু বন্ধুর সঙ্গে তাঁকেও বাধ্যতামূলক ভাবে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হয়। ভিয়েতনামে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে কয়েক মাস যুদ্ধ করে সম্প্রতি তিনি ফিরে এসেছেন। কিন্তু বন্ধুরা কেউ ফেরেনি। তাই এমন মহাশত্রু ‘কমি’-দের প্রতি পিট-এর এত দরদ তিনি মেনে নিতে পারেন না, অতএব পিটকে খুন করতে হবে।
৯৪ বছরের জীবনে, প্রায় ঋষিসুলভ এই মানুষটির সমালোচক তথা শত্রুর অভাব হয়নি। তাঁর গান বহু বছর রেডিয়ো এবং টিভিতে নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল মার্কিন সরকার। ষাটের দশকে যখন আমেরিকান সমাজ কমিউনিস্ট জুজুর ভয়ে কাঁটা, তখন ইট মেরে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে তাঁর গানের অনুষ্ঠান। তা সত্ত্বেও বিভিন্ন রকম প্রতিকূলতা পেরিয়ে পিট গান গেয়ে গিয়েছেন সারা জীবন। লোকগান, জীবনের গান, সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষের গান, প্রতিবাদের গান। এমনকী এই কয়েক মাস আগেও তাঁকে গাইতে দেখা গিয়েছে ফার্ম এড অনুষ্ঠানে। সারা জীবন বস্তুবাদ ও ধনতন্ত্রের পীঠস্থান আমেরিকায় থেকেও মনেপ্রাণে এবং দৈনন্দিন জীবনে থেকেছেন সাধারণ, অনাড়ম্বর। নিজের এবং নিজের সঙ্গীতের বাণিজ্যকরণ এড়িয়ে চলেছেন। মানুষের প্রতি ভালবাসা, সমবেদনা, সহমর্মিতা তাঁর জীবনের এবং গানের মূল মন্ত্র হয়ে উঠেছে। গান দিয়ে তিনি এক সূত্রে জুড়তে চেয়েছেন মানুষকে। পিট সিগার সত্যি সত্যি জনগায়ক।
পিটের বাবা-মা ক্লাসিকাল সঙ্গীতের চর্চা করতেন। বাবা বাজাতেন পিয়ানো, মা বেহালা। আমেরিকার গ্রামেগঞ্জে ‘ভাল’ মিউজিক, অর্থাত্‌ বাখ, মোত্‌সার্ট, ভিভালডি-র সঙ্গীত পৌঁছে দেওয়ার স্বপ্ন দেখতেন পিটের বাবা, চার্লস লুই সিগার। তাই সপরিবার ঘুরে বেড়াতেন, অনুষ্ঠান করতেন বিভিন্ন অঞ্চলে। তখনই তাঁরা শুনতে পান সেই সব অঞ্চলের সাধারণ গ্রাম্য মানুষের নিজেদের গান। এবং তা শুনে চার্লস নিজেই আকৃষ্ট হয়ে পড়েন লোকসঙ্গীতে। তাঁর হাত ধরে তাঁর ছেলে পিটও ভালবাসতে শুরু করে এই গান। বছর আটেক যখন বয়স, তখন হাতে আসে ইউকিলিলি বলে একটি যন্ত্র, অনেকটা ছোট গিটারের মতো। সেই যন্ত্র বাজিয়ে ছোট্ট পিট শিখতে থাকেন নানা রকম প্রচলিত আমেরিকান লোকসঙ্গীত স্কিপ টু মাই লু, ও সুজানা, ইয়াঙ্কি ডুড্ল ও আরও অনেক গান। শিখতে শিখতে গাইতে গাইতে এক দিন এসে পড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। সেই সময় কমিউনিস্ট মতাদর্শের সঙ্গে পিটের পরিচয় হয় এবং কমিউনিজমের যুদ্ধ ও হিটলার-বিরোধী ভাবধারা, সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চিন্তা তাঁকে অনুপ্রাণিত করে। পিট কমিউনিস্ট পার্টিতে নাম লেখান। তত দিনে ইউকিলিলি ছেড়ে তিনি হাতে তুলে নিয়েছেন ব্যাঞ্জো। বিভিন্ন শ্রমিক সমাবেশে গান গেয়ে বেড়াতে বেড়াতে এক দিন আলাপ হয় প্রবাদপ্রতিম লোকসঙ্গীত গায়ক উডি গাথরি-র সঙ্গে। উডির সঙ্গে আমেরিকার নানা প্রান্তে ঘুরে ঘুরে অনুষ্ঠান করতে করতে দেশকে এবং দেশের মানুষকে আরও ভাল করে চিনতে শেখেন পিট। দিস ল্যান্ড ইজ ইয়োর ল্যান্ড/ দিস ল্যান্ড ইজ মাই ল্যান্ড/ ফ্রম ক্যালিফোর্নিয়া/ টু নিউ ইয়র্ক আইল্যান্ড উডির এই গানে ফুটে ওঠা আমেরিকার সঙ্গে পরিচয় ঘটে পিটের।
১৯৪০ নাগাদ উডি গাথরির সঙ্গে পিট তৈরি করেন অ্যালম্যানাক সিঙ্গার্স নামে একটি গানের দল। লেবার সং বা শ্রমিকদের গান গাইবার জন্য একটি দল বানানো তাঁর অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল হার্ড হিটিং সংস ফর হার্ড হিট পিপল। বছর দুয়েক তাঁরা চুটিয়ে লোকগান, প্রতিবাদী গান, বর্ণবিদ্বেষ-বিরোধী গান গেয়ে বেড়ান নানা জায়গায়, বেশ নামও হয়। কিন্তু গান গেয়ে অর্থ বা খ্যাতি উপার্জন করা নয়, পিটের লক্ষ্য ছিল গানের মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছনো এবং গানকে মানুষের কাছে পৌঁছনো। কিছু দিন পর দল ভেঙে যায়, পিট তৈরি করেন উইভার্স বলে আর একটি দল। দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে দলটি। তাঁদের গান ‘টার্ন টার্ন টার্ন’ এখনও বিভিন্ন শিল্পী রেকর্ড করেন। হুডি লেডবেটার-এর কাছে শেখা ‘গুডনাইট আইরিন’ গানটিও খুব জনপ্রিয় হয় সেই সময়ে। কিংস্টন ট্রায়ো-র মতো ব্যান্ডও অনুপ্রাণিত হয় উইভার্সের গানে। কিন্তু বিধি বাম! এফ বি আই বামপন্থী স্ট্যাম্প লাগিয়ে দেয় উইভার্স-এর ওপর। তাঁদের গানে সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। কমিউনিস্টদের সমর্থনের জন্য পিটকে আদালতে যেতে হয়। গানের ওপর নেমে আসে কারফিউ!
প্রায় সাত বছর নিষিদ্ধ থাকার পর কার্নেগি হলে একটি অনুষ্ঠান করে উইভার্স আবার একসঙ্গে গান গাইতে শুরু করে। কিন্তু এই নতুন পর্ব বেশি দিন টেকে না, কারণ পিটের সায় ছাড়াই উইভার্স একটি সিগারেটের বিজ্ঞাপন করে। পিটও উইভার্স ছেড়ে দেন। এবং মানুষের মাঝে পৌঁছে গিয়ে গান শোনাতে থাকেন। ১৯৫৩ থেকে ১৯৬০, তিনি ইস্কুলে ইস্কুলে গিয়ে ছোটদের পরিচয় করিয়ে দেন তাদের শিকড়ের সঙ্গে ডার্লিং ক্লেমেন্টাইন, জন হেনরি, মাইকেল রো দ্য বোট অ্যাশোর-এর মতো গান প্রথম বার শোনে তারা। কলেজে কলেজে গিয়ে তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে থাকেন সাম্যের গান। ছাত্রদের সমর্থনও মেলে প্রচুর। টিভি বা রেডিয়োয় পিটের গান তেমন না শোনা গেলেও, তলে তলে তৈরি হতে শুরু করে লোকসংগীত-কেন্দ্রিক এক নতুন আন্দোলন। আর্লো গাথরি, উডির ছেলে, হাত মেলান পিটের সঙ্গে। ১৯৬২ সালে কমিউনিস্ট হওয়ার অভিযোগ থেকে মুক্তি পেয়ে পিট সপরিবার বেরিয়ে পড়েন বিশ্বভ্রমণে। নানা দেশ ঘুরে অসংখ্য লোকগান সংগ্রহ করেন। পরবর্তী কালে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অ্যাফ্রিকান লোকসংগীত উইমওয়েহ্, হোসে মার্তির রচিত স্প্যানিশ গান গুয়ানতানামেরা ও আরও অনেক দেশের লোকগান তাঁর অনবদ্য গায়কীতে প্রথম বার আমেরিকান দর্শক-শ্রোতার কাছে প্রকাশ পায়।
তত দিনে আমেরিকায় এসে গেছে ফোক রিভাইভাল সাধারণ মানুষের তৈরি শহুরে ও অ-শহুরে লোকগানের এক নতুন সংস্কৃতি, এসে গেছেন বব ডিলান, জোন বায়েজ, পিটার পল অ্যান্ড মেরি, দ্য বার্ডস। শুরু হয়ে গেছে নিউপোর্ট ফোক ফেস্টিভাল-এর মতো বিশাল লোকসংগীতের উত্‌সব। পিটের তৈরি ইফ আই হ্যাড আ হামার-এর মতো গান জনপ্রিয় হয়ে উঠছে নতুন শিল্পীদের গলায়। পিট সিগারও স্বাভাবিক ভাবেই যুক্ত হয়ে গেলেন এই মুভমেন্টের সঙ্গে। নতুন নতুন অনেক গান তৈরি হচ্ছিল সেই সময়ে। পিটও খুঁজে বের করতে লাগলেন সেই রকম গান। ম্যালভিনা রেনল্ডস-এর ‘লিটল বক্সেস’, টম প্যাক্সটনের ‘হোয়াট ডিড ইউ লার্ন ইন স্কুলে টুডে’ বা বব ডিলানের ‘হার্ড রেনস আ গ’না ফল’ গানগুলো পিটের ব্যাঞ্জো বেয়ে পৌঁছে গেল শ্রোতার কাছে।
আমেরিকায় সিভিল রাইটস মুভমেন্ট চলার সময় মার্টিন লুথার কিং-এর একটি সমাবেশে পিট প্রথম বার গাইলেন বহু দিন আগের একটি গসপেল প্রভাবিত গান: উই উইল ওভারকাম। গানটির একটি শব্দ পাল্টে নিয়ে পিট করে নেন ‘উই শ্যাল ওভারকাম’। একটি নতুন স্তবকও জুড়ে দেন গানে: উই ওয়াক হ্যান্ড ইন হ্যান্ড। তার পর ইতিহাস! গানটি সিভিল রাইটস মুভমেন্টের অ্যান্থেম হয়ে ওঠে। বিশ্ব জুড়ে অসংখ্য ভাষায় অনুবাদ করা হয় এ গান। যেখানেই সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ জানাতে চেয়েছেন, এ গানতাঁদের লড়াইয়ের ভাষা হয়ে উঠেছে, লড়াইয়ে প্রেরণা দিয়েছে।
পিট সিগারের সঙ্গে আমারও প্রথম পরিচয় এই গানটির হাত ধরেই। আমরা করব জয় নিশ্চয় স্কুলে গাওয়া হত। অবশ্য তখন পিট সিগারের নাম যে জানতাম তা নয়। জানতে পারি রেডিয়োতে পাশ্চাত্য গানের অনুষ্ঠান মিউজিকাল ব্যান্ডবক্স শুনে। মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। তার পর বেশ কিছু বছর পরে কবীর সুমনের গলায় পিট সিগারের গান আবার শুনি: ওয়ান ব্লু স্কাই অ্যাবাভ আস ওয়ান ওশান ল্যাপিং অন আওয়ার শোর ওয়ান আর্থ সো গ্রিন অ্যান্ড ব্রাউন হু কুড আস্ক ফর মোর... সুমনদা-র কাছেই শুনি পিট সিগারকে নিয়ে আরও নানা রকম অবাক করা গল্প, কলকাতায় দু’জনের একসঙ্গে অনুষ্ঠান দেখারও সৌভাগ্য হয়। পিট সিগার-পাগল আর এক মানুষের সঙ্গেও পরিচয় হয়: আমার বন্ধু প্রবুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায়। পিট সিগারের বহু অচেনা গান ওর কাছেই শুনেছি। পিট সিগারকে নতুন ভাবে বুঝতে শুরু করি তার পর থেকে। মানবজাতিকে যিনি ‘রেনবো রেস’ নামে ডাকতে পারেন, সেই মানুষটির জীবনযাপন, সংগীতভাবনা অন্য সবার চেয়ে যে আলাদা হবে, তাতে আর আশ্চর্য কী?
পিট সিগারের গান পরবর্তী প্রজন্মের অসংখ্য শিল্পীকে অনুপ্রাণিত করেছে। রক গায়ক ব্রুস স্প্রিংস্টিন পিটের গান নিয়ে একটি পুরো অ্যালবাম কয়েক বছর আগে রেকর্ড করেছেন। বিলি জোয়েল নিউ ইয়র্কের লং আইল্যান্ডের মত্‌স্যজীবীদের নিয়ে ‘ডাউনইস্টার অ্যালেক্সা’ গানটি বাঁধার আগে স্মরণ করেছেন পিট সিগারকে। গত শতাব্দীতে পাশ্চাত্য পপ সংগীত যে ধারায় এগিয়েছে, তার পিছনে পিট সিগারের ভূমিকা বব ডিলান বা বিটলসের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়।
শুরুর গল্পে ফিরে যাই। খুন করতে আসা যুবকটির সঙ্গে গ্রিনরুমে আড্ডায় বসলেন পিট। কিছু ক্ষণ বাদে দেখা গেল, দু’জনে মিলে একসঙ্গে গান গাইছেন: হোয়্যার হ্যাভ অল দ্য ফ্লাওয়ার্স গন মিখাইল শলোকভ-এর ‘অ্যান্ড কোয়ায়েট ফ্লোজ দ্য ডন’ উপন্যাসের একটি অংশ থেকে আইডিয়া পেয়ে যে গানটি পিট বেঁধেছিলেন কিছু দিন আগে। যুদ্ধ হলে রাস্তায় ফুলও খুঁজে পাওয়া যায় না, কারণ সব ফুল চলে যায় মৃত সৈনিকদের কবরে। যুদ্ধের অন্তঃসারশূন্যতা, প্রিয়জনকে হারানোর বেদনা যে সর্বত্রই একই রকম, সে কথা বুঝতে পেরে যুবকটির চোখ ভিজে ওঠে। চলে যাওয়ার আগে তিনি বলে যান: আই ফিল ক্লিন।
আজকের এই রাজনীতি, হিংসা, লোভ, সন্ত্রাস, বাজার অর্থনীতির যুগে আর ক’জনের গান শুনে এই কথা আমাদের মনে হয়?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.