নগর পুড়িলে দেবালয় অক্ষত থাকিতে পারে, কিন্তু শিল্পবাণিজ্য নিরাপদ থাকিতে পারে না। বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার মাসুল গনিতেছে দেশের অর্থনীতি। বিরোধী বিএনপি এবং জামাতে ইসলামি জোট মাসের পর মাস যে ভাবে জনজীবনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করিয়াছে, তাহাদের হিংসাত্মক আন্দোলন এবং সেই আন্দোলন দমনে সরকারের প্রশাসনিক তত্পরতা যে ভাবে প্রায় দৈনন্দিন সংঘর্ষের রূপ ধারণ করিয়াছে, তাহার কুফল অনিবার্য ছিল। ক্রমশ অর্থনৈতিক তথ্য পরিসংখ্যান সেই কুফলের মাত্রাটি স্পষ্ট জানাইয়া দিতেছে। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক আয়বৃদ্ধির প্রত্যাশিত হার কমাইয়া দিয়াছে। বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক আগে বলিয়াছিল, চলতি আর্থিক বছরে (২০১৩’র জুলাই হইতে ২০১৪’র জুন) দেশের আয় সাত শতাংশ বৃদ্ধি পাইবে। এখন তাহার অনুমান: ছয় শতাংশ। বিশ্বব্যাঙ্ক, আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার (আই এম এফ) বা এশীয় উন্নয়ন ব্যাঙ্কের (এ ডি বি) মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলি বলিয়া আসিতেছিল, ২০১৩-১৪ সালে বাংলাদেশের আর্থিক বৃদ্ধি ছয় শতাংশের নীচে থাকিবে। বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক শেষ অবধি সেই ধারণাই অনুমোদন করিল। এবং কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের গভর্নর স্পষ্ট জানাইয়া দিয়াছেন, দৈনন্দিন জীবন ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হইবার ফলেই এই অধোগতি।
বিশৃঙ্খলা এবং হিংস্রতার রাজনীতি ভারতীয় উপমহাদেশে অর্থনীতির অগ্রগতি কী ভাবে বিপন্ন ও বিপর্যস্ত করে, তাহার বহু নমুনা এই অঞ্চলের দেশগুলি দেখিয়াছে। ভারত কোনও অংশে তাহার ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশের পক্ষে এই বিপর্যয় বিশেষ ভাবে দুর্ভাগ্যজনক এবং বিপজ্জনক। বাংলাদেশ আর্থিক সমৃদ্ধির মাপকাঠিতে দুনিয়ার দরিদ্র দেশগুলির সারিতে। আয়ের বিচারে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যেও তাহার স্থান পিছনের সারিতে। এখনও অনেক বছর দ্রুত আয়বৃদ্ধি করিতে পারিলে তবেই এই দেশটির গড়পড়তা আয় কিছুটা নিরাপদ উচ্চতায় পৌঁছাইবে, দারিদ্রের প্রকোপ কিছুটা কমিবে। দরিদ্র দেশের পক্ষে ধারাবাহিক আয়বৃদ্ধি প্রায় আক্ষরিক অর্থে জীবনমরণ প্রশ্ন। সেই কারণেই উন্নয়নের অনুকূল রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশ অত্যন্ত জরুরি। বিশৃঙ্খলা ও অনিশ্চয়তা এই কারণেই বিপজ্জনক।
দুর্ভাগ্যজনকও। অনুন্নয়ন ও দারিদ্র সত্ত্বেও বাংলাদেশ গত দুই দশকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ সাফল্য অর্জন করিয়াছে। বিশেষত স্ত্রীশিক্ষা, নারী ও শিশুর স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি, মেয়েদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ইত্যাদি বিষয়ে তাহার অগ্রগতি কেবল প্রশংসনীয় নয়, অনুকরণীয়। অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন-সহ অনেক বিশেষজ্ঞ এবং গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান এই সাফল্যকে সম্মান জানাইয়াছেন, ভারতের মতো দেশকে ইহা হইতে শিখিবার পরামর্শ দিয়াছেন। রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা এই অগ্রগতিকে দুই ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করিতে পারে। এক, বিনিয়োগ, আয়বৃদ্ধি এবং পরিকাঠামোর প্রসার ব্যাহত হইলে সামাজিক উন্নয়নও ধাক্কা খাইতে বাধ্য সমাজকল্যাণের রসদ আয়বৃদ্ধি হইতেই আসে। দুই, অস্থিরতা ও হিংসা সমাজকল্যাণের কাজে সরাসরি বাধা সৃষ্টি করে। নগর পুড়িলে বিদ্যালয় বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রও নিশ্চিন্ত থাকিতে পারে না। রাজনীতির পরিসরে অতিরিক্ত নেতিবাচক আচরণের ফলে খালেদা জিয়া অধুনা অনেকখানি কোণঠাসা। দৃশ্যত, কিঞ্চিত্ উদ্বিগ্নও। এই উদ্বেগ যদি তাঁহাকে ও তাঁহার সহমর্মীদের শান্তি এবং আলাপ-আলোচনার পথে ফিরাইতে পারে, বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় অর্থনীতি উন্নয়নের পথে ফিরিতে পারে। |