রাজধানী দিল্লিতে অরুণাচল প্রদেশের ছাত্র নিদো টানিয়ামের মৃত্যুর পরে উত্তর -পূর্ব ভারতের ছাত্রছাত্রী ও সহমর্মীরা যে সব দাবি তুলিয়াছেন, তাহাদের মধ্যে রহিয়াছে জাতিবৈষম্য বিরোধী একটি আইন প্রণয়নের দাবি। অনিবার্য প্রশ্ন : আইন করিয়া কি জাতিবৈষম্য দূর করা যায়? সামাজিক অপরাধ দমনে আইনের কোনও ভূমিকা নাই, এমন কথা নিশ্চয়ই সত্য নয়। বস্তুত, রাষ্ট্র যথেষ্ট কঠোর এবং তত্পর হইলে, আইন যথেষ্ট সহায়ক হইলে সামাজিক সংস্কারের চেষ্টা তুলনায় সফল হইতে পারে, ইহার নানা নিদর্শন ইতিহাসের নানা অধ্যায়ে ছড়াইয়া আছে। কিন্তু বৈষম্য যেখানে দৈনন্দিন আচরণের মজ্জাগত, সেখানে আইনের দৌড় কতটুকু? প্রশ্নটি দুই দিক হইতে প্রাসঙ্গিক। এক দিকে, কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর উপর আক্রমণ, নির্যাতন বা অপমান দেশের স্বাভাবিক আইনেই অন্যায়, তাহা প্রতিরোধের জন্য স্বতন্ত্র আইনের প্রয়োজন নাই। অন্য দিকে, যে মানসিকতা হইতে এই ধরনের অন্যায় সংঘটিত হইয়া থাকে, তাহা আইন করিয়া তাড়ানো সম্ভব নয়। বরং আইন প্রণয়ন করিয়া সরকার ভাবিতে পারে তাহার দায় ফুরাইয়াছে এবং সমাজ মনে করিতে পারে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর প্রাপ্য রক্ষাকবচ মিলিয়া গিয়াছে। এই দেশে অতিরিক্ত আইন প্রণয়নের একটি প্রবণতা বিভিন্ন ক্ষেত্রেই লক্ষ করা যায়। জাতিবৈষম্যের প্রশ্নেও তাহার পুনরাবৃত্তি দুর্ভাগ্যজনক হইবে।
নিদো টানিয়ামের মর্মান্তিক মৃত্যু রাজনীতি ও সমাজের বিভিন্ন মহলে কিছুটা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করিয়াছে। এই প্রতিক্রিয়ার কতটা আন্তরিক আর কতটা রাজনৈতিক হিসাবনিকাশের ব্যাপার, সেই প্রশ্ন থাকিবেই। কিন্তু অনেক সময়েই রাজনীতির হিসাবনিকাশের মধ্য হইতেও সমাজমানসের আত্মসমীক্ষার সুযোগ মিলিয়া যায়, মৌলিক সমস্যা বা ব্যাধির উপর নজর পড়ে। এ ক্ষেত্রেও তাহার সুযোগ আছে। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ বলিয়াছেন, এই ধরনের লজ্জাকর হিংস্রতা মানবিক মূল্যবোধের বিরোধী, ইহা দেশের ঐক্যের ভিত নষ্ট করিয়া দিতে পারে। হিংস্রতা প্রকট হইলে, বিশেষত মৃত্যু ডাকিয়া আনিলে তবেই এই সকল লজ্জা এবং আশঙ্কার কথা ওঠে কেন? দৈনন্দিন আচরণে যখন বিভিন্ন ‘প্রান্তিক’ জনগোষ্ঠীর প্রতি সমাজের ‘মূলধারা’র অবিশ্বাস এবং অমর্যাদা ছায়া ফেলিতে থাকে, তখন কি তাহা কম লজ্জার? কম আশঙ্কার? সেই অবিশ্বাস এবং অমর্যাদা প্রতিহত করিতে রাষ্ট্র, রাজনীতি ও সমাজের নায়করা কতটুকু উদ্যোগ করেন? আজ যদি তাঁহারা নিজেদের এই প্রশ্নটির মুখোমুখি দাঁড় করাইতে পারেন, তবেই হয়তো যথার্থ উত্তরণের পথ মিলিতে পারে।
সেই পথের প্রাথমিক নির্দেশিকাটি অত্যন্ত স্পষ্ট। তাহার অপরিহার্য শর্ত : বিভিন্নতাকে গ্রহণ করা, সম্মান জানানো। উত্তর -পূর্ব ভারতের মানুষকে আপন দেশে যে ধরনের বিরূপতার সম্মুখীন হইতে হয়, তাহার কারণ একটিই : তাঁহারা ‘অন্য রকম’। শারীরিক গঠনে, ভাষায়, আচরণে, সংস্কৃতিতে, নানা ভাবে অন্য রকম। এই স্বাতন্ত্রের কারণেই তাঁহারা ভারতীয় জীবন ও সমাজের বিশেষ সম্পদ। বস্তুত, বিভিন্ন ধরনের মানুষ তাঁহাদের বিভিন্নতা লইয়া এই দেশের জীবন ও সমাজের শরিক, ইহাই ভারতীয়তার যথার্থ শক্তি ও ঐশ্বর্য। কিন্তু সেই শক্তি ও ঐশ্বর্যের সাধনা করিতে হইলে বিভিন্নতাকে কেবল স্বীকার করিলে চলিবে না, তাহাকে আন্তরিক ভাবে সম্মান জানাইতে হইবে। কেবল উত্তর -পূর্ব ভারতের মানুষকে নয়, বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মানুষকে, তাঁহাদের সাংস্কৃতিক বিভিন্নতা হইতে শিখিতে হইবে। ‘মূলধারা’র ভারত বলিয়া যে সমাজ গর্বিত, এই শিক্ষাই তাহার বাঁচিবার একমাত্র উপায়। ‘অন্য রকম’ বলিয়া কাহাকেও ছোট করিয়া নয়, ‘অন্য রকম’কে গ্রহণ করিয়াই ভারতবর্ষ সমৃদ্ধ হইয়াছে। আইন করিয়া ভারততীর্থ রচনা সম্ভব নয়। |