বছর ছয়েক আগে পরিকল্পনা হয়েছিল কামালগাজি থেকে ঢালাই ব্রিজ পর্যন্ত বাইপাস সম্প্রসারণের। কিন্তু বাদ সাধে একটি ধর্মস্থান। সরকারের তরফে ওই ধর্মীয় স্থান অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। কিন্তু হাজার চেষ্টাতেও তা সরানো যায়নি।
বছর ১৫ ধরে একই ভাবে থমকে গিয়েছে বিমানবন্দরের দ্বিতীয় রানওয়ে সম্প্রসারণের কাজ। এখানেও বাধা একটি ধর্মীয় স্থান। ১৫ বছর ধরে বহু আলাপ-আলোচনা চালিয়েও ধর্মীয় স্থান সরিয়ে দ্বিতীয় রানওয়ে সম্প্রসারণের কাজ শুরুই করা যায়নি।
ঝাড়খণ্ড পারে। অতীতে বিহার, গুজরাতের মতো অন্য কয়েকটি রাজ্যও পেরেছে। পেরেছে ধর্মীয় আবেগের টানাপোড়েন কাটিয়ে উঠে এলাকার উন্নয়নকেই অগ্রাধিকার দিতে। তারা পারলেও কলকাতা শহর তা পারে না কেন? |
রাজ্য প্রশাসনের কর্তারা বলছেন, সদিচ্ছার অভাব এবং ধর্মীয় আবেগ কাটিয়ে ওঠার সাহস না দেখাতে পারাই এর পিছনে প্রধান কারণ। আর সেটাই কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন ঝাড়খণ্ডের রামগড় জেলার কাঁকেবার এলাকার মানুষ। তাই তাঁরা জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণের জন্য মসজিদ সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্তে সায় দেন।
কামালগাজি ঢালাই ব্রিজের কাছে ধর্মীয় স্থান সরানোর প্রশ্নে তা কিন্তু হচ্ছে না। বছর চারেক আগে কলকাতা মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (কেএমডিএ)-র তরফে ওই ধর্মীয় উপাসনার জন্য পাশেই একটি নতুন জায়গা বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেখানে যেতে চাইছেন না ওই ধর্মস্থানের সঙ্গে যুক্তেরা। তাঁদের বক্তব্য, “মন্দিরের মা ওখানে যেতে চান না।” এলাকার বাসিন্দা সহদেব মণ্ডলের দাবি, “কেএমডিএ-র লোকেরা তো ভাঙতে এসেছিলেন। কিন্তু পারেননি। তার পরেই তো বাসিন্দারা প্রশাসনকে বাধা দিয়েছে।” যদিও কেএমডিএ কর্তাদের যুক্তি, “প্রথমে ওই কংক্রিটের বেদীটি ভাঙতে গিয়ে দেখা যায়, শক্তপোক্ত ওই কাঠামোটি ভাঙতে নিউম্যাটিক হ্যামার লাগবে। কিন্তু তার আগেই রটিয়ে দেওয়া হয়, ভগবান যেতে চান না বলেই ওটি ভাঙা যাচ্ছে না। তার পরে বাসিন্দাদের বাধায় ওই ধর্মস্থান আর ভাঙা যায়নি। ওইটুকুর জন্য বাইপাসের সম্প্রসারণের কাজ থমকে গিয়েছে।”
একই ভাবে বিমানবন্দরের ভিতর থেকে ধর্মস্থান সরানোর সম্ভাবনাই আর নেই বলে দাবি করছেন ওখানকার কমিটির প্রধান সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী। তাঁর দাবি, “২৫ বছর ধরে চেষ্টার পরে ধর্মস্থানটি সংস্কারের অনুমতি দিয়েছেন বিমানবন্দর-কর্তৃপক্ষ। সেই অনুমতি পেয়ে ছ’লক্ষ টাকা খরচ করে নতুন করে সেটি তৈরি করা হয়েছে। এর পরে তো আর সরানোর প্রশ্নই ওঠে না।” বিমানবন্দর-কর্তৃপক্ষ অবশ্য সিদ্দিকুল্লার দাবি নাকচ করে দিয়ে জানিয়েছেন, এ রকম কোনও অনুমতি দেওয়াই হয়নি। কলকাতা বিমানবন্দরের অধিকর্তা বি পি শর্মা বলেন, “বিমানবন্দরের গেট থেকে ধর্মস্থান পর্যন্ত আসার রাস্তা ভেঙেচুরে গিয়েছিল। সেখান দিয়ে প্রতি দিন লোক যাতায়াত করতেন। তাই সেই রাস্তা একটু সারিয়ে দিয়েছি। কিন্তু সংস্কারের অনুমতি দেওয়া হয়নি।”
কলকাতা বিমানবন্দরের ভিতরে যেখানে দ্বিতীয় রানওয়ে, তার উত্তর দিকে এই ধর্মস্থান রয়েছে। বিরাটি ছাড়িয়ে বাঁকড়ার কাছে বিমানবন্দরের যে ৮ নম্বর গেট রয়েছে, সেখান থেকে একটি রাস্তা গিয়েছে ওই ধর্মস্থান পর্যন্ত। সেই রাস্তা দিয়ে বাঁকড়ার সাধারণ মানুষ যাতায়াত করেন। তাঁদের যাতায়াতের জন্য যে রাস্তা রয়েছে, তার দু’দিকে নিরাপত্তা খাতিরে আলাদা করে পাঁচিল দেওয়া রয়েছে। সিদ্দিকুল্লার দাবি, যে জমিটির উপরে ধর্মস্থান রয়েছে, সেটি বিমানবন্দরের ভিতরে থাকলেও তা বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের জমি নয়। তিনি বলেন, “এ নিয়ে বিস্তর আলাপ-আলোচনা হয়েছে। আমরা শেষে বলেছিলাম, আমাদের ধর্মের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা করা হোক। সেই আবেদনে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ কর্ণপাত করেননি। এখন সংস্কারের পরে কী করে সরানো সম্ভব?”
শুধু বিমানবন্দরের রানওয়ে কিংবা বাইপাসের সম্প্রসারণের কাজই নয়, কলকাতা ও শহরতলি এলাকার বিভিন্ন জায়গায় এমন উদাহরণ অনেক রয়েছে। পূর্ত দফতরের এক কর্তার কথায়, “বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ধর্মীয় আবেগ নিয়ে কেউই নাড়াচাড়া করতে চান না। বিশেষত, শাসক দল ভোটব্যাঙ্ক নষ্ট হওয়ার ভয়ে এ সব বিষয়ে ঘাঁটাতে চান না। তাই অনেক ক্ষেত্রেই ধর্মীয় স্থান থাকার কারণে বিভিন্ন এলাকায় রাস্তা সম্প্রসারণের কাজ থমকে যায় বা ওই এলাকাটি বাদ দিয়ে রাস্তা সম্প্রসারণ করতে হয়।” পূর্ত দফতরের কর্তারা উদাহরণ দিচ্ছেন টালিগঞ্জ ফাঁড়ির আগে আনোয়ার শাহ মোড়ের কথা। সেখানে একসঙ্গে দু’টি পৃথক ধর্মের ধর্মস্থান রয়েছে। অনেক বারই রাস্তা চওড়া করতে দু’টি ধর্মস্থান সরানোর অনুরোধ করা হয়েছে। কিন্তু করা যায়নি। শেষমেশ ওই এলাকাটুকু ছেড়ে দিয়েই হয়েছে রাস্তা সম্প্রসারণ। |