শর্ট স্ট্রিট-কাণ্ডের পরে পরে অভিযোগ উঠেছিল, সেখানে হামলাকারীদের মদত দিয়েছে পুলিশেরই একাংশ। তার জেরে শেক্সপিয়র সরণি থানার এক সাব ইনস্পেক্টরকে সাসপেন্ডও করা হয়। এবং নুর আলি নামে ওই এসআই শর্ট স্ট্রিট-কাণ্ড সংক্রান্ত জেনারেল ডায়েরি (জিডি)-তে কারচুপি করে মিথ্যে তথ্য দাখিলও করেছিলেন বলে চার্জশিটে অভিযোগ আনল কলকাতা গোয়েন্দা-পুলিশ। নুর এখন জেল হেফাজতে।
পুলিশ জানায়, ১১ নভেম্বর সেই হামলার আগেও শেক্সপিয়র সরণি থানা-এলাকার ৯এ শর্ট স্ট্রিটের জমিটি ঘিরে একাধিক বার অশান্তি দানা বেঁধেছিল, যার তদন্তের দায়িত্বে ছিলেন নুর আলি। ১১ নভেম্বরের ঘটনায় দুই হামলাকারীর মৃত্যু হয়, জখম হয় তিন জন। তদন্তকারীদের দাবি: নিজের মাথা বাঁচাতে নুর তখনই পুরনো তারিখ বসিয়ে থানায় একটি জিডি করেন। তাতে লিখেছিলেন, ৯এ শর্ট স্ট্রিটে ফের গোলমাল হতে পারে, তাই ওই বাড়ির সামনে দু’জন কনস্টেবলকে রাখা হয়েছে। দুই কনস্টেবলের নামও তিনি জিডি-তে উল্লেখ করেছিলেন।
কিন্তু ঘটনার ৮৭ দিনের মাথায়, বুধবার কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দারা আদালতে যে চার্জশিট পেশ করেছেন, তাতে নুর আলির করা জিডি-র সত্যতার দিকেই আঙুল উঠেছে। তদন্তকারীদের বক্তব্য, উল্লিখিত দুই কনস্টেবলকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গিয়েছে, বাড়িটির সামনে তাঁরা ডিউটি করেননি। ১১ নভেম্বরে তো নয়ই, তার আগেও নয়।
১১ নভেম্বর কাকভোরে খোদ পুলিশ কমিশনারের বাড়ির পিছনে ১৭ কাঠা জমি সমেত বাড়িটির দখল নিতে চড়াও হয় এক দল লোক। পাঁচিল টপকে ক’জন চৌহদ্দিতে ঢুকে পড়ে। ভিতর থেকে গুলি চলে। তাতেই প্রাণ যায় দুই বহিরাগতের, আহত হয় একাধিক ব্যক্তি। পরে জানা যায়, হতাহতেরা একটি নিরাপত্তাসংস্থার ‘বাউন্সার।’ সম্পত্তি দখলে তাদের ওখানে পাঠানো হয়েছিল। বাড়িটিতে একটি মন্টেসরি স্কুল চালাতেন মমতা অগ্রবাল নামে এক মহিলা। অভিযোগ, গুলি চালিয়েছিলেন মমতা ও তাঁর এক সঙ্গী। ওঁদের তো বটেই, পুলিশ-নিরাপত্তাকর্মী, আইনজীবী, জমি-বাড়ির কারবারি-সহ ১৫ জনকে ধরা হয়েছে। ফেরার তিন জন।
আর খাস মহানগরে জমি ঘিরে এ হেন লড়াইয়ের পিছনে পুলিশের একাংশের যোগসাজশের ছায়াও প্রকট হয়ে ওঠে। যার ভিত্তিতে নুর আলির অপসারণ ও গ্রেফতারি। চার্জশিটে ওঁকে হামলার অন্যতম ষড়যন্ত্রী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মূল ষড়যন্ত্রী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন সম্পত্তি-কারবারি পরাগ মজমুদার। অভিযোগ, ৯এ শর্ট স্ট্রিটের জমি দখলের দায়িত্ব পরাগই সঁপেছিলেন সহযোগী পিনাকেশ দত্ত ও আইনজীবী সামির রিয়াজের হাতে। চার্জশিটের দাবি, কাজ হাসিল করতে মোট দেড় কোটি টাকা লেনদেন হয়েছিল, যার আশি লক্ষের হদিস মিলেছে পিনাকেশের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে।
শর্ট স্ট্রিট-কাণ্ডে মোট দু’টো মামলা দায়ের হয়েছে। একটি হল ষড়যন্ত্র ও বলপূর্বক অনুপ্রবেশের, অন্যটি খুনের। এ দিন ব্যাঙ্কশাল কোর্টে মুখ্য মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেট বিশ্বরূপ শেঠের আদালতে প্রথম মামলাটির চার্জশিট পেশ হয়েছে। তাতে নুর-পরাগ-পিনাকেশ-রিয়াজ ছাড়াও নাম রয়েছে আইনজীবী পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও সম্পত্তির কারবারি রাজেশ দামানি-সহ মোট ১৮ জনের। এঁদের মধ্যে ফেরার তিন জন বারুইপুরের সংশ্লিষ্ট সিকিওরিটি এজেন্সি’র মালিক অরূপ দেবনাথ, তাঁর সঙ্গী সুমন পাত্র এবং সংস্থার বাউন্সার কৌশিক আঢ্য, গুলিতে যাঁর চোখ জখম হয়। আটশো পাতার চার্জশিটে লিপিবদ্ধ হয়েছে ১০১ সাক্ষীর বয়ান। এই মামলায় অভিযুক্ত ১৮ জনের ৯ জন ইতিমধ্যে জামিন পেয়ে গিয়েছেন। এ দিন নুর আলি-সহ চার জন জামিনের আবেদন করলে সরকারি কৌঁসুলি কৃষ্ণচন্দ্র দাস বিরোধিতা করেন। বিচারক জামিনের আর্জি খারিজ করে দেন।
নুরের বিরুদ্ধে অভিযোগ: ১১ নভেম্বর তিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত না-থাকলেও কখন কাকে কী করতে হবে, সে ব্যাপারে পরাগ ও তাঁর দলবলকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। এমনকী, ঘটনার অব্যবহিত পরে তিনি পরাগ-পিনাকেশ-সামিরদের সঙ্গে একশো বারেরও বেশি মোবাইল ফোনে কথা বলেন। চার্জশিট মোতাবেক, নুরের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে কোনও টাকা উদ্ধার না-হলেও তদন্তে দেখা গিয়েছে, সাব ইনস্পেক্টর হিসেবে প্রাপ্য বেতনের টাকা দীর্ঘ দিন তাঁর অ্যাকাউন্ট থেকে তোলা হয়নি।
এ দিনের চার্জশিটে তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, ৯এ শর্ট স্ট্রিটের সম্পত্তি দখলের লক্ষ্যে ছক কষা হয়েছিল বহু দিন ধরে। চক্রীরা জানত, বাড়িতে একটি রিভলভার রয়েছে। গত ১৫ সেপ্টেম্বর হানা দিয়ে সেটি লুঠ করে পালায় এক দল দুষ্কৃতী। ভবিষ্যৎ হামলার পথে প্রতিরোধের কাঁটা দূর করতেই রিভলভার লুঠের পরিকল্পনা হয়েছিল বলে তদন্তকারীরা পরে জানতে পেরেছেন। গোয়েন্দাদের বক্তব্য: আরও দু’টো বন্দুক যে বাড়িতে রয়েছে, পরাগ-পিনাকেশদের তা জানা ছিল না। ফলে তারা ভেবেছিল, নিরুপদ্রবে দখলদারি কায়েম করা যাবে।
বস্তুত তারা এতটাই নিশ্চিন্ত ছিল যে, ১১ নভেম্বরের হামলার সময়ে কোনও আগ্নেয়াস্ত্রও সঙ্গে আনেনি বলে জানিয়েছেন তদন্তকারীরা। |
অভিযোগের ধারাপাত* |
• ১২০বি অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র
• ১৪৮ সংঘর্ষের জন্য সশস্ত্র জমায়েত
• ১৪৯ একই উদ্দেশ্যে অবৈধ জমায়েত
• ৪৫৮ আঘাতের উদ্দেশ্যে রাতে ঘর বা দেওয়াল ভেঙে প্রবেশ
• ৪৫৯ ওই ভাবে প্রবেশকালে বা পরে কাউকে গুরুতর আঘাত
*ভারতীয় দণ্ডবিধির যে যে ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে |
|