মাত্র এক বছর চলার পরে সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার ইতি ঘটল দক্ষিণ ভাটোরা গ্রামে।
হাওড়ার ‘দ্বীপাঞ্চল’ নামে পরিচিত জয়পুরের ঘোড়াবেড়িয়া-চিৎনান এবং ভাটোরা এই দু’টি পঞ্চায়েত এলাকার মানুষের জন্য ২০১২ সালের ১ সেপ্টেম্বর দক্ষিণ ভাটোরা গ্রামে চালু হয়েছিল একটি স্বাস্থ্য শিবির। বেসরকারি উদ্যোগের সঙ্গে হাত মিলিয়ে শিবির চালু করেছিল জেলা স্বাস্থ্য দফতর।
মুণ্ডেশ্বরী ও রূপনারায়ণ দিয়ে ঘেরা দ্বীপাঞ্চলটির প্রধান অসুবিধা হল যোগাযোগ ব্যবস্থা। মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সড়ক পথে যোগাযোগ না থাকায় এখানে যাতায়াত করতে ভরসা একমাত্র নৌকো। তাতে চড়ে কুলিয়াঘাটে নামার পরে হেঁটে অন্তত এক ঘণ্টা লাগে ভাটোরা উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পৌঁছতে। এই অসুবিধার জন্য এখানে চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা বদলি হতে চান না বলে জেলা স্বাস্থ্য দফতর সূত্রেই জানা গিয়েছে। বছরপাঁচেক আগে ভাটোরা উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রকে ১০ শয্যায় উন্নীত করার সিদ্ধান্ত হলেও এখনও ভবন তৈরির কাজই শেষ হয়নি। বর্হিবিভাগ চালু থাকলেও চিকিৎসক নিয়মিত আসেন না বলে গ্রামবাসীদের অভিযোগ। |
এই পরিস্থিতিতেই দক্ষিণ ভাটোরা গ্রামে শিবির করে চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার পরিকল্পনা করে জেলা স্বাস্থ্য দফতর। এ বিষয়ে তারা দিল্লিতে জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনের কাছে যে প্রকল্প রিপোর্ট পাঠায় সেটি অনুমোদিত হয়। তারপরেই চালু হয় স্বাস্থ্য পরিষেবা। একটি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে শিবির চালানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়।
বহু মানুষ, বিশেষ করে মহিলা এবং প্রসূতিরা এই শিবিরে নিয়মিত পরিষেবা পেতেন। প্রতি সপ্তাহে দু’টি করে শিবির বসানো হত বিভিন্ন এলাকায়। এ ছাড়াও বাড়তি শিবির বসত। সব মিলিয়ে মাসে অন্তত ১০টি করে চিকিৎসা শিবির বসত। মহিলা ও প্রসূতি তো বটেই, অন্যান্য রোগীরাও নিয়মিত সেখানে আসতেন। সাধারণ চিকিৎসক ছাড়াও ছিলেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। বিনামূল্যে এই পরিষেবা দেওয়া হত। ছিল এক্স-রে, ইসিজি, রক্ত পরীক্ষার ব্যবস্থা। সবই পাওয়া যেত বিনামূল্যে। শারীরিক ভাবে দুর্বল রোগীদের শিবির পর্যন্ত বয়ে আনার জন্য ছিল ডুলির ব্যবস্থা। মোট চারটি ডুলি রাখা হয়েছিল। একটি নৌকোকে ‘মাতৃযান’এ পরিণত করা হয়েছিল। গুরুতর অসুস্থদের নৌ-মাতৃযানে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া হত অ্যাম্বুল্যান্স পর্যন্ত। স্থলপথে আবার ওই অ্যাম্বুল্যান্স রোগীদের নিয়ে ছুটত শহরতলির বিভিন্ন হাসপাতালে। এক বছরে ১০ হাজার ৩২০ জনকে চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া হয় এখান থেকে। ডুলি, নৌ-মাতৃযান এবং অ্যাম্বুল্যান্সে চাপিয়ে মোট ৩৬ জন প্রসূতিকে উন্নত হাসপাতালে প্রসব করানো হয়। ৩০ জন গুরুতর অসুস্থ সদ্যোজাতের চিকিৎসা হয়েছিল এখানে।
কিন্তু শিবিরের মেয়াদ ছিল মাত্র এক বছর। মেয়াদ ফুরনোর পরে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে শিবির। ফলে দ্বীপাঞ্চলের বাসিন্দারা ফিরে গিয়েছেন সেই তিমিরেই। তাঁরা অবিলম্বে শিবিরটি ফের চালু করার দাবি জানিয়েছেন। জেলা স্বাস্থ্য দফতরও মনে করে শিবির ফের চালু করা উচিত। এ বিষয়ে তাঁদের তরফে উদ্যোগ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন হাওড়ার সিএমওএইচ দেবাশিস রায়। তিনি বলেন, “জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশন প্রকল্পে পরীক্ষামূলক ভাবে শিবিরটি চালু করা হয়েছিল। এক বছর চলার পরে আমরা মূল্যায়ণ করে দেখেছি, শিবিরটির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার টাকা দিলে ফের শিবির চালু করা হবে।” স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, এলাকার প্রয়োজন যে এক বছরে ফুরবো না, কিংবা বাকি পরিকাঠামো যে রাতারাতি ভাল হয়ে যাবে না, তা জানেন দফতরের কর্তারাও। সে ক্ষেত্রে পরীক্ষামূলক ভাবে এক বছরের জন্য হলেও শিবির ফের চালু করার ব্যাপারে তাঁদের ভাবনা-চিন্তা আছে।
এলাকার বাসিন্দারা ইতিমধ্যেই জেলা স্বাস্থ্য দফতর-সহ বিভিন্ন মহলে শিবির ফের চালু করার আবেদন জানিয়েছেন। সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রীরও দ্বারস্থ হয়েছেন তাঁরা। এলাকার প্রাক্তন পঞ্চায়েত সদস্য দীপঙ্কর হাজরা বলেন, “দ্বীপাঞ্চলের মানুষ স্বাস্থ্য পরিষেবা থেকে বঞ্চিত। শিবির চালু হওয়ায় আমরা উপকৃত হয়েছিলাম। আমি নিজে ডুলি কাঁধে বহু রোগীকে শিবিরে এনেছি। শিবির বন্ধ হয়ে যাওয়ায় খুব খারাপ লাগছে।” চিকিৎসক নয়নরঞ্জন পাঁজা বলেন, “আমাকে এখনও গ্রামবাসীরা ফোন করে বলেন কেন শিবিরে যাচ্ছি না। কিন্তু শিবির না হলে যাব কোথায়?” যে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হাতে শিবিরের দায়িত্ব ছিল, তার কর্ণধার শক্তিপদ দলুই বলেন, “আমাদের পরিকাঠামো সবই রয়েছে। ফের শিবির খোলা হলে তা চালাতে অসুবিধা হবে না।” তবে সিএমওএইচ জানিয়েছেন, জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশন প্রকল্পে অনুমতি এলেই শিবির ফের চালু করা সম্ভব হবে। |