মিটারে কারচুপি করে বিদ্যুৎ চুরির অভিযোগ দীর্ঘ দিন ধরে রয়েছে এক শ্রেণির গ্রাহকের বিরুদ্ধে। আবার মিটারের ‘রিডিং’ নিতে ভুলের জেরেও যে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন কোম্পানিকে ফি বছর মোটা টাকা লোকসান গুনতে হয়, সংস্থা কর্তৃপক্ষ তা বার বার স্বীকার করেছেন। এই জোড়া সমস্যার কিছুটা সুরাহা করতে এ বার শুরু হয়েছে প্রযুক্তির সাহায্যে বাণিজ্যিক গ্রাহকদের (হাই ভোল্টেজ বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী) মিটারে নজরদারি। যার সুবাদে বণ্টন সংস্থা ইদানীং ঘরে বসেই জেনে যাচ্ছে, ওই গ্রাহকেরা প্রতি দিন কত ইউনিট বিদ্যুৎ খরচ করছেন। লোক পাঠিয়ে মিটার পরীক্ষার দরকার পড়ছে না।
বণ্টন-সূত্রের খবর: বড়-মাঝারি কারখানা, হাসপাতাল, নার্সিংহোম, হোটেল-সহ যে সব প্রতিষ্ঠান ৫০ কিলো ভোল্ট অ্যাম্পিয়ার (কেভিএ) বা তার বেশি ভোল্টেজের বিদ্যুৎ পরিষেবা নিয়ে থাকে, তাদের এই নজরদারির আওতায় আনা হচ্ছে। ইতিমধ্যে হাজারখানেক গ্রাহকের মিটারে বিশেষ প্রযুক্তিটি প্রয়োগ করা হয়েছে। লক্ষ্য রয়েছে আগামী এক-দেড় বছরের মধ্যে আরও পাঁচ হাজার গ্রাহককে নতুন ব্যবস্থার আওতায় আনার। বণ্টন-কর্তৃপক্ষের দাবি: সব ঠিকঠাক চললে ওই সব গ্রাহকের মিটারের ‘রিডিং’ নিতে কাউকে পাঠাতে হবে না। অফিসে বসেই বিদ্যুৎ-বিল বানিয়ে ফেলা যাবে। পাশাপাশি মিটারে কোনও কারচুপি হলে ধরা যাবে সঙ্গে সঙ্গে।
নতুন ব্যবস্থা কার্যকর করা হচ্ছে কী ভাবে?
বণ্টন কোম্পানি সূত্রের খবর: বাণিজ্যিক গ্রাহকদের পুরনো মিটার বদলে দিয়ে ডিজিট্যাল মিটার লাগানো হচ্ছে। তাতে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে একটি মোডেম, যার সঙ্গে থাকছে একটা সিমকার্ড। জিপিআরএস (জেনারেল প্যাকেট রেডিও সার্ভিস) প্রযুক্তির দৌলতে সিমকার্ড মারফত গ্রাহকের বিদ্যুৎ খরচ সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য সরাসরি চলে যাচ্ছে বণ্টন কোম্পানির নিজস্ব ডেটা সেন্টারে। যে ভাবে একটি মোবাইল থেকে কোনও মেসেজ বা তথ্য অন্য মোবাইল নম্বরে পাঠানো যায়, এখানেও পদ্ধতিটা ঠিক তা-ই।
আর এ ক্ষেত্রে বণ্টন সংস্থা ব্যবহার করছে বিএসএনএলের টেলিকম পরিকাঠামো (মোবাইল টাওয়ার)। সফ্টওয়্যার-সহ অন্যান্য প্রযুক্তিগত নেটওয়ার্ক বানিয়ে দিয়েছে রাজ্যের এক তথ্য-প্রযুক্তি সংস্থা। বণ্টন সংস্থার চেয়্যারমান ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর নারায়ণস্বরূপ নিগম বলেন, “শুধু মিটারে নজরদারি নয়। গ্রাহকেরা ঠিকঠাক ভোল্টেজের বিদ্যুৎ পাচ্ছেন কি না, তা-ও বোঝা যাবে অফিসে বসেই। ভোল্টেজ সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান চটজলদি করা যাবে।” এতে সংস্থার আর্থিক লোকসানের বোঝা কিছুটা হলেও লাঘব করা যাবে বলে চেয়ারম্যান আশাবাদী। “কারণ গ্রাহক জানছেন, তাঁর বিদ্যুৎ ব্যয়ের খুঁটিনাটি তথ্য এখন আমাদের নজরে। ফলে বিদ্যুৎ চুরির প্রবণতা কমবে।” ব্যাখ্যা এক বিদ্যুৎ-কর্তার।
সিইএসসি অবশ্য এমন ব্যবস্থা চালু করেছে বেশ কিছু দিন আগে। কলকাতা-হাওড়া মিলিয়ে তাদের হাজার দেড়েক বাণিজ্যিক গ্রাহকের মিটারে মোডেম বসে গিয়েছে। মিটারগুলোর রিডিং এখন সিইএসসি ঘরে বসেই নেয়। সেই মতো মাসের শেষে বিল পাঠিয়ে দেয়।
আর্থিক ক্ষতি কমানোর লক্ষ্য নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ-সহ বিবিধ রাজ্যের বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থাকে নানাবিধ সংস্কারের পথে হাঁটার পরামর্শ দিয়েছে কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ মন্ত্রক। এ জন্য গ্রাহক পরিষেবার সব ক্ষেত্রেই যাতে তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো হয়, সে ব্যাপারে তারা জোর দিয়েছে। এবং সেই বাবদ খরচের প্রায় পুরোটা দিল্লি-ই বহন করছে। মিটারে মোডেম বসিয়ে বিদ্যুৎ খরচে নজরদারির প্রক্রিয়াটিও এই উদ্যোগের অঙ্গ। রাজ্য বিদ্যুৎ দফতরের খবর, তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে সংস্কারের স্বার্থে কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গকে যে ১৬৪ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে, মিটারে মোডেম বসানো হচ্ছে সেই তহবিল থেকে।
পশ্চিমবঙ্গের ৭২টি ছোট-মাঝারি শহরের বিভিন্ন বাণিজ্যিক গ্রাহকের বিদ্যুৎ-মিটার এ ভাবে নজর-জালে এনে ফেলা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বণ্টন সংস্থার এক কর্তা। |