পর পর ডাকাতির ঘটনায় বনগাঁর গোপালনগরের মানুষ এখন আতঙ্কিত। স্থানীয় চালকী এলাকায় বনগাঁ পঞ্চায়েত সমিতির প্রাক্তন সভাপতি সৌমেন দত্তর বাড়িতে মঙ্গলবার ভোররাতে ফের ডাকাতিতে সেই আতঙ্ক আরও চেপে বসেছে। দত্ত পরিবারের দাবি, ডাকাতেরা নগদ দেড় লক্ষ টাকা, ৭০ ভরি সোনার গয়না, কয়েকটি ঘড়ি ও মোবাইল ফোন লুঠ করে নিয়ে গিয়েছে।
এলাকার মানুষের অভিযোগ, আগের ঘটনাগুলি নিয়ে পুলিশ যথেষ্ট তৎপর হলে এই পরিবেশ তৈরি হত না। একের পর এক ডাকাতির পরেও পুলিশ কাউকে ধরতে না পারায় দুষ্কৃতীরাও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
আশপাশের এলাকায় ডাকাতির ঘটনা লোকমুখে, খবরের কাগজ মারফত জেনেছিলেন সৌমেন দত্ত। সেইমতো সব সময় বাড়ির লোকজনকে সাবধান, সতর্ক থাকতে বলতেন। কিন্তু তাই বলে তাঁর বাড়িতেও ডাকাত পড়বে এতটা কল্পনাতেও আনতে পারেননি তিনি।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, গত বছর ৪ সেপ্টেম্বর ভরদুপুরে মোটরসাইকেলে করে সশস্ত্র দুষ্কৃতীর একটি দল একটি চটের কারখানার কর্মীদের কাছ থেকে কয়েক লক্ষ টাকা ছিনতাই করে পালিয়ে যায়। কারখানার দু’জন কর্মী সমস্ত কর্মীদের বেতনের টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তুলে কারখানায় ফিরছিলেন। ঘটনার পর জেলার পুলিশ সুপার-সহ পদস্থ পুলিশ কর্তারা তদন্তে করে দ্রুত দুষ্কৃতীদের গ্রেফতারের আশ্বাস দিয়েছিলেন। বলাবাহুল্য কেউ ধরা পড়েনি। টাকাও উদ্ধার হয়নি। এর পর গত ২০ জানুয়ারি সাতবেড়িয়ায় বাড়িতে চড়াও হয়ে আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে সোনার গয়নাগাটি-সহ নগদ কয়েক হাজার টাকা নিয়ে চম্পট দেয় ডাকাতরা। এক্ষেত্রেও দুষ্কৃতীদের গ্রেফতার বা টাকা-গয়না উদ্ধার করা যায়নি। ফের সৌমেনবাবুর বাড়িতে ডাকাতি হওয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই পুলিশের নিষ্ক্রিয় ভুমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। এলাকার মানুষের বক্তব্য, আগের ডাকাতিগুলিতে পুলিশ যথাযথ তদন্ত করে দুষ্কৃতীদের গ্রেফতার করলে তারা এতটা বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারত না। যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে, তাতে কালই আর কারও বাড়িতে হামলা হতে পারে। নিরাপত্তা কোথায়? বাসিন্দাদের আরও অভিযোগ, গোপালনগর বাজার এলাকায় রোজ চোলাইয়ের ঠেক বসে। স্থানীয় দুষ্কৃতীদের পাশাপাশি বাইরে থেকে এমনকী বাংলাদেশি দুষ্কৃতীদেরও আনাগোনা রয়েছে ওই সব ঠেকে। রাতে বনগাঁ-চাকদহ সড়কে অচেনা যুবকদের ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। তাঁদের চোখে যদি এ সব ধরা পড়ে তা হলে পুলিশের চোখে কী পড়ে না? |
পুলিশ সূ্ত্রের খবর, বনগাঁ-চাকদহ রাস্তার ধারে তিনতলা বাড়ি সৌমেনবাবুদের। ভাই প্রদীপবাবুর ট্রাক, রেশন ও ইমারতি দ্রব্যের কারবার রয়েছে। পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, মঙ্গলবার রাত তখন আড়াইটে। জনা কয়েক সশস্ত্র দুষ্কৃতী নীচের তলার গ্রিলের দরজার তিনটি তালা ভেঙে ঢুকে পড়ে। দোতলায় ওঠার দরজাতেও চারটি তালা লাগানো ছিল। দুষ্কৃতীরা সেগুলিও ভেঙে সৌমেনবাবুর দাদা প্রদীপবাবুর ঘরে ঢোকে। তিনি ঘুমিয়েছিলেন। আগ্নেয়াস্ত্র ঠেকিয়ে তাঁকে ঘুম থেকে টেনে তোলে তারা। এর পর একে একে তাঁর স্ত্রী সুনীতাদেবী ও ছেলে পীযূষ-সহ অন্যান্য ঘর থকে ৬ জনকে টেনে তোলে দুষ্কৃতীরা। প্রদীপবাবুর কথায়, “ওরা আমাকে বলে সোনার মূর্তিটা কোথায় আছে বল। আমি কিছু বলতে গেলে মারধর শুরু করে। এর পর ওরা আলমারি ভাঙতে গেলে বাধ্য হয়ে ওদের হাতে চাবি তুলে দিই। আলমারি লন্ডভন্ড করে সোনার গয়নাগাটি ও নগদ টাকাকড়ি নিয়ে নেয় ওরা। ওদের কাছে কাছে বোমা ছিল। বার বারই ভয় দেখাচ্ছিল।” সেখান থেকে পাশেই ঠাকুরঘরে হানা দেয় দুষ্কৃতীরা। সেখান থেকে কৃষ্ণের একটি ছোট মূর্তি তুলে নেয়। এর পর তিনতলার তালাও ভেঙে ওপরে উঠে যায় তারা। সৌমেনবাবু তিনতলাতেই থাকেন। তবে তাঁর ঘরে আর না ঢুকে প্রদীপবাবুকে নিয়ে নীচে নেমে আসে তারা। অফিস ঘর ও লাগোয়া রেশন দোকানের সামেন এসে চাবি চায়। প্রদীপবাবু ওপরে গিয়ে চাবি আনতে হবে বলায় দুষ্কতীরা তাতে রাজি হয়নি। লোহার রড দিয়ে তালা ভেঙে ঘরে ঢুকে জিনিসপত্র লন্ডভন্ড করে। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে লুঠপাট চালিয়ে সবাইকে বিছানার চাদর দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধে। চিৎকার করলে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকিও দেয়। তবে যাওয়ার আগে প্রদীপবাবুর অনুরোধে তাঁর হাতের বাঁধন খুলে দিয়ে যায় তারা।
প্রদীপবাবু বলেন, “দুষ্কৃতীরা আগে থেকে খবর নিয়েই এসেছিল। বাড়িতে ঢুকে তারা প্রথমেই ফোনের লাইন কেটে দেয়। মোবাইল ফোনগুলো কেড়ে নেয়। ওদের কথা শুনে মনে হচ্ছিল বাড়িতে সোনার মূর্তি আছে বলে ওরা খবর পেয়েছিল। বারবারই বলছিল মূর্তিটা পাওয়া গেল না।” তিনি জানান, ঠাকুরঘরে পিতলের বেশ কয়েকটি দেবদেবীর মূর্তি রয়েছে। সম্ভবত সেগুলিকেই সোনার ভেবে কেউ খবর দিয়েছিল দুষ্কৃতীদের। তবে যাওয়ার আগে কৃষ্ণের একটি ছোট মূর্তি নিয়ে গিয়েছে দুষ্কৃতীরা। তারা চলে গেলে প্রদীপবাবু ভাইকে ডাকেন। তাতেই ঘুম ভাঙে সৌমেনবাবুর। নীচে নেমে ভাইয়ের মুখে সমস্ত ঘটনা শুনে থানায় খবর দেন। ঘটনাস্থলে যান বনগাঁর এসডিপিও রূপান্তর সেনগুপ্ত ও গোপালনগর থানার ওসি দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। দুষ্কৃতীদের একটি মারুতি গাড়ি আটক করেছে পুলিশ।
বুধবার সৌমেনবাবুর বাড়িতে যান স্থানীয় বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস। সমস্ত শুনে ডিজি-র কাছে আইনশৃঙ্খলার অবনতি এবং আগের ঘটনাগুলিতে দুষ্কৃতীদের গ্রেফতার না হওয়া নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। পুলিশকে উদ্দেশ করে তিনি জানান, আগের ঘটনাগুলিতে দুষ্কৃতীরা ধরা না পড়াতেই ফের এমন ঘটনা ঘটেছে।” এমন ঘটনা যাতে না ঘটে সে জন্য পুলিশকে কড়া ব্যবস্থা নিতে বলেন তিনি। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায় বলেন, “আগের সবক’টি ঘটনার তদন্ত চলছে। দুষ্কৃতীরা গ্রেফতার হবেই।” পুলিশের কড়া নজরদারি থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাসিন্দাদের তিনি আশ্বস্ত করেন।
যদিও বাসিন্দাদের বক্তব্য, আশ্বাস নয়, তাঁরা চান দুষ্কৃতীদের গ্রেফতার। |