প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও শীতের সকালে বালিশের তলা থেকে মলিন ভোটার কার্ডটা বের করলেন বিজয়পুরের বিজন বিশ্বাস। বিএসএফের নজরদারি চৌকিতে ওই কার্ড জমা দিয়ে, নানা প্রশ্নবাণ সামলে তারপর মিলবে খেতে কাজ করার অনুমতি। কিন্তু বাড়ি থেকে বেরনোর মুখে পিছু ডাকলেন মা‘‘খেতে কাজ করার সময় চোখ-কান খোলা রাখিস বাবা। তেমন বিপদ বুঝলে ঝুঁকি নেওয়ার দরকার নেই। সোজা বাড়ি চলে আসবি।’’ শুধু বিশ্বাস পরিবারই নয়, সীমান্তের খেতে কাজ করতে গেলে বহু পরিবারই এখন এমন দুশ্চিন্তায় থাকছেন।
নদিয়ার গেদে, নোনাগঞ্জ, চাপড়া কিংবা বিজয়পুর সীমান্তে খেতে কাজ করার সময় চাষিদের যেভাবে তুলে নিয়ে যাওয়া কিংবা মারধরের অভিযোগ উঠছে প্রতিবেশী দেশের সীমান্তরক্ষী ও দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে তাতে অনেকেই সিঁদুরে মেঘ দেখছেন। পুলিশ ও বিএসএফ সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী শুধু কৃষ্ণগঞ্জ থানা এলাকাতেই জানুয়ারি মাসে কাঁটাতারের ওপার থেকে দু’ জন চাষিকে তুলে নিয়ে গিয়েছে পড়শি দেশের সীমান্তরক্ষীরা। ঘটনার কিছু দিন পরেই বিজয়পুরের এক চাষিকে কোপানোর অভিযোগ উঠেছে পড়শি ওই দেশের দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি গেদে সীমান্তে খেতে কাজ করার সময় ফের এক চাষিকে ধরে নিয়ে যায় প্রতিবেশী দেশের সীমান্তরক্ষীরা। সীমান্তের চাষিরা সমস্বরে বলছেন, “আবার কি সেই আগের অবস্থা ফিরে এল নাকি? ভয়ে যেতে হচ্ছে মাঠে কাজ করতে। সবসময় মনে হচ্ছে এই বুঝি কিছু ঘটে গেল!”
এলাকার মানুষের দাবি, বাংলাদেশের কেউ এপারে আসতে গিয়ে বিএসএফের হাতে ধরা পড়ার পরে পাল্টা চাপ দিতে কখনও কখনও এমন ঘটনা ঘটায় পড়শি দেশের কিছু দুষ্কৃতী। অতীতেও এমন বেশ কিছু নজির রয়েছে। কিন্তু এ বার ওই দেশের সীমান্তরক্ষীরা দু’জন চাষিকে যেভাবে ধরে নিয়ে গেল তাতে উদ্বেগ যেন আরও বেড়েছে। নদিয়ার জেলাশাসক পি বি সালিম বলেন, “প্রতিবেশী দেশের সীমান্তরক্ষীরা দু’জন চাষিকে তুলে নিয়ে গিয়েছে বলে যে অভিযোগ উঠেছিল সেই ব্যাপারে বিএসএফের কাছে রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছিলাম। বিএসএফ জানিয়েছে, ওই দুই চাষি প্রতিবেশী দেশের সীমান্তে ঢুকে পড়েছিলেন। ফলে এ ক্ষেত্রে আইনি লড়াই করা ছাড়া আর উপায় নেই।”
কিন্তু বাকি ঘটনাগুলোর ব্যাপারে কী ভাবছে প্রশাসন? জেলাশাসক বলেন, “নদিয়া জেলায় বিএসএফের মোট ৬টি ব্যাটেলিয়ন রয়েছে। খুব শীঘ্র ওই ব্যাটেলিয়নের কম্যান্ডারদের সঙ্গে আমরা আলোচনায় বসব। জেলার পুলিশ সুপারও থাকবেন ওই বৈঠকে। সেখানেই এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার পর উপযুক্ত পদক্ষেপ করা হবে।”
বছর কয়েক আগে নদিয়ার সীমান্ত ছিল একেবারেই অন্যরকম। তাঁরকাটার ওপারে ভারতীয় জমি থেকে ফসল চুরি, চাষি অপহরণ কিংবা সীমান্তের গ্রামে ঢুকে চুরি-ডাকাতি-খুন ছিল প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা। চোরাপাচারের কথা বলাই বাহুল্য। পড়শি দেশের দুষ্কৃতীর তাণ্ডবে তটস্থ থাকত ধানতলা, হাঁসখালি, কৃষ্ণগঞ্জ, চাপড়া, তেহট্ট, করিমপুর, মুরুটিয়া কিংবা হোগোলবেড়িয়া থানার সীমান্তঘেঁষা গ্রামগুলি। কিন্তু পরে অবস্থার অনেক পরিবর্তনও হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক এই ঘটনাগুলো ফের যেন সেই পুরনো স্মৃতিই উস্কে দিচ্ছে।
দিনকয়েক আগে কৃষ্ণগঞ্জের গেদে ও নোনাগঞ্জ এলাকার দুই চাষিকে কাঁটাতারের ওপারের খেত থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছে দুষ্কৃতীরা। প্রতিবেশী দুই দেশের সীমান্তরক্ষীরা একাধিকবার ফ্ল্যাগ মিটিং করার পরেও এখনও পর্যন্ত তাঁদের ফিরিয়ে আনা যায়নি। শনিবার বিজয়পুর এলাকার এক বাসিন্দার কাছ থেকে জোর করে গরু ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে ওপারের দুষ্কৃতীরা। বাধা দিতে গেলে তাঁকে ধারাল অস্ত্র দিয়ে কোপানো হয় বলে অভিযোগ। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তিনি এখন শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এই ঘটনার পর এলাকার মানুষ স্থানীয় বিএসএফ ক্যাম্পে বিক্ষোভও দেখান।
নোনাগঞ্জের বাসিন্দা তথা নদিয়া জেলা পরিষদের সদস্য তৃণমূলের অশোক হালদার বলেন, “এর আগে কাঁটাতারের ওপার থেকে অবাধে ফসল চুরি করে নিয়ে যেত দুষ্কৃতীরা। কিন্তু এখন তো দেখছি প্রতিবেশী ওই দেশের সীমান্তরক্ষীরাও আমাদের চাষিদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে।”
একই অভিযোগ চাপড়া সীমান্তের চাষিদেরও। স্থানীয় পঞ্চায়েত সমিতির প্রাক্তন সদস্য কংগ্রেসের সাহেব আলি সর্দার বলেন, “মাঝখানে ওদের তাণ্ডব কিছুটা কমেছিল। কিন্তু ফের তা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। প্রশাসন দ্রুত কোনও পদক্ষেপ না করলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যাবে।”
|