সরস্বতী পুজোর সকাল। প্রতিমা দর্শন করতে স্কুল চত্বরে সুদৃশ্য মণ্ডপের সামনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ছেন অনেকেই। বিস্ময়ের ঘোর কিছুটা কাটিয়ে প্রতিমার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে স্কুলের পড়ুয়ারা। ভেসে আসছে উদাত্ত কন্ঠে মন্ত্রোচ্চারণ
‘সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে
বিশ্বরূপে বিশালাক্ষ্মী বিদ্যাং দেহি নমহস্তুতে...’।
পুরোহিতের পরনে চওড়া লাল পাড়ের সাদা বেনারসি, গলায় গরদের উত্তরীয়, কপালে সদ্য শেষ হওয়া হোমের টিপ।
চিরাচরিত প্রথা ভেঙে নবদ্বীপ বালিকা বিদ্যালয়ের সরস্বতী পুজোয় এবার পৌরোহিত্য করলেন স্কুলেরই সংস্কৃতের শিক্ষিকা পূরবী ভট্টাচার্য। নবজাগরণের অগ্রপুরুষ চৈতন্যদেবের লীলাভূমি, নবদ্বীপে প্রথা ভাঙার এমন নজিরে কিন্তু বেজায় খুশি স্কুলের ছাত্রীরা। ‘অ্যাই, স্কুলের পুজোতে এ বার দিদি পুজো করছেন, শুনেছিস?’ক’দিন ধরে স্কুলময় এই বার্তা রটে যাওয়ার ফল যা হওয়ার তাই হয়েছিল। দিদির পুজো করা দেখতে ছাত্রীদের ভিড় উপচে পড়েছিল স্কুলে। ঘণ্টা চারেক ধরে যাবতীয় শাস্ত্রীয় প্রথা মেনে হোমসহ পুজো করলেন পূরবীদেবী। |
একদা বিশ্ববিদ্যালয় নগরী হিসাবে পরিচিত নবদ্বীপে শতবর্ষ পার করা বা শতবর্ষ ছুঁইছুঁই স্কুলের সংখ্যা দশ-বারোটি। কিন্তু ১৯২৮ সালে প্রতিষ্ঠিত নবদ্বীপ বালিকা বিদ্যালয়-ই প্রথম প্রথা ভাঙার সাহস দেখাল বলে দাবি স্কুল কর্তৃপক্ষের। স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা শ্রুতি লাহিড়ি বলেন, “বৈদিক যুগে নারীরা যজ্ঞ করতেন। ঋকবেদের কিছু সূক্ত নারীরা রচনা করেছেন। এখনও বিভিন্ন মহিলা পরিচালিত মঠে সন্ন্যাসিনীরাই পুজো করে থাকেন। তবে স্কুলের মতো কোনও প্রতিষ্ঠানে হয়তো বা এটাই প্রথম।”
কিন্তু হঠাৎ এমন ভাবনা কেন? প্রধানশিক্ষিকা বলেন, “মেয়েদের স্কুলের সবটাই যখন মেয়েদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় তখন পুজোটাই বা বাদ থাকবে কেন? এই ভাবনা থেকেই এমন সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন স্কুলের সকলেই। আর ছাত্রীরা যে কতটা খুশি তা তো নিজের চোখেই দেখছেন।”
কৃষ্ণনগরের নেদের পাড়ার বাসিন্দা পূরবীদেবীর বাপের বাড়িতে সংস্কৃতের বিলক্ষণ চর্চা ছিল। তাঁর ঠাকুর্দার বাবা অবিনাশ তর্করত্ন ছিলেন প্রসিদ্ধ নৈয়ায়িক। বিদ্যাসাগরের ঘনিষ্ঠ তর্করত্ন মহাশয় ‘মহামহোপাধ্যায়’ নামে ন্যায়ের উপর একটি গ্রন্থও লিখেছিলেন। পূরবীদেবী নিজের বাড়িতে পুজো করলেও বাইরে অবশ্য এই প্রথমবার। পুজোয় বসে কেমন লাগল? হাসতে হাসতে তিনি বলেন, “সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে স্কুলে আসা পর্যন্ত একটু ভয় ভয় করছিল। কিন্তু আসনে বসে পুজোর উপকরণগুলো ছুঁতেই যেন সব ভয় কেটে গেল।”
স্কুল পড়ুয়া শ্রেয়সী, শালিনীরা বলছে, “প্রথমে আমরা ভাবতেই পারিনি যে সত্যিই দিদি পুজো করবেন। কী সুন্দর করে পুজো করছিলেন। ধূপের গন্ধ, উদাত্ত গলায় মন্ত্রোচ্চারণ, সব মিলিয়ে সে এক অদ্ভুত পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। আমরা চাই এ বার থেকে প্রত্যেক বছর স্কুলের সরস্বতী পুজো
দিদিই করুন।” |