প্রবন্ধ...
দুর্নীতি কমানোর পথ জানা, কিন্তু সেটা যথেষ্ট নয়
ই লেখায় দুর্নীতি রোধের আইনি ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করব। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো ‘ক্রাইম ইন ইন্ডিয়া’ নামে একটি রিপোর্ট তৈরি করে। তার নবম অধ্যায়ে দুর্নীতি নিবারণ আইন (পি সি এ) এবং ভারতীয় দণ্ডবিধির সংশ্লিষ্ট ধারার আওতাধীন অর্থনৈতিক অপরাধ বিষয়ে তথ্য পাওয়া যায়। সরকারি ও আধা-সরকারি ক্ষেত্র মিলিয়ে দুর্নীতি নিবারণ আইন ও ভারতীয় দণ্ডবিধির সংশ্লিষ্ট ধারাগুলির আওতায় পড়েন প্রায় সাড়ে চার কোটি কর্মী। যদি দশ শতাংশ কর্মীও দুর্নীতিগ্রস্ত হন, তা হলেও অন্তত ৪৫ লক্ষ অভিযোগ থাকার কথা। তার কত শতাংশের বিচার হয়? নিশ্চিত বলা কঠিন, একটা আন্দাজ তৈরি করা চলে।
প্রথমত, সব দুর্নীতির অভিযোগ বিচারযোগ্য নয়, অর্থাৎ সেগুলি আদালত অবধি গড়ায় না, কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিভাগীয় তদন্তই যথেষ্ট। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে বলা যায়, দুর্নীতির বিচারযোগ্য অভিযোগের মোটামুটি আট শতাংশ নথিভুক্ত হয়, তার মধ্যে আটাশ শতাংশ ক্ষেত্রে চার্জশিট দাখিল করার সম্ভাবনা থাকে, আর যত অভিযোগের ক্ষেত্রে চার্জশিট দাখিল করা হয়, তারও গড়পড়তা আটাশ শতাংশ ক্ষেত্রে শাস্তি হয়। তার মানে, দুর্নীতির মোট যত অভিযোগ, তার ০.৬ শতাংশ ক্ষেত্রে শাস্তি হয়। যে কোনও মাপকাঠিতেই এটা যে নিতান্ত কম, তা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না। প্রসঙ্গত, কত দিন বিচার চলে বা শাস্তির বহর কতটা, সে বিষয়ে যথেষ্ট তথ্যই পাওয়া যায় না।
প্রতীকী। গাঁধীজির মৃত্যুদিনে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান। আজাদ
ময়দান, মুম্বই। ৩০ জানুয়ারি, ২০১৪। ছবি: পি টি আই।
এর পরিণাম: দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে ভাল লাভ করা যায়, ধরা পড়ার ঝুঁকি কম। অর্থনীতির যুক্তি বলে যে, দুর্নীতির সম্ভাব্য শাস্তির ‘খরচ’ যদি প্রত্যাশিত ‘আয়’-এর চেয়ে বেশি হয়, তবেই দুর্নীতি নিবারণের একটা সম্ভাবনা থাকে। ভারতে এখন প্রত্যাশিত আয় বিপুল, সম্ভাব্য খরচ খুব কম। ফলে প্রচলিত ব্যবস্থায় দুর্নীতি উৎসাহিত হয়। ফৌজদারি অপরাধের বিচার ব্যবস্থায় যে সব ত্রুটি আছে, সেগুলির ফলেই সাধারণ ভাবে দুর্নীতির মাত্রা বেশি হয়।
তবে এখানে একটা কথা বলা দরকার। পুলিশ, সি বি আই বা সি ভি সি’র মতো প্রতিষ্ঠানগুলি নিয়ে সমস্যা অনেক, কিন্তু এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাজ্যের অবস্থা বিভিন্ন রকম। আমরা এই তারতম্যের একটা হিসেব কষেছি। চারটে আলাদা আলাদা সময়ের পরিসংখ্যান নিয়ে এই হিসেব তৈরি। সময়পর্বগুলি প্রত্যেকটি পাঁচ বছর করে: ১৯৯১-৯৫, ১৯৯৬-২০০০, ২০০১-০৫, ২০০৬-১০। বিভিন্ন বিষয়ে বার্ষিক পরিসংখ্যান নিয়ে সেগুলির পাঁচ বছরের গড় হিসেব কষে কয়েকটি অনুপাত বের করা হয়েছে।
ছ’টি অনুপাত হল:
(১) প্রতি এক হাজার সরকারি কর্মী পিছু ক’জন প্রেফতার হয়েছেন,
(২) মোট যত অভিযোগের তদন্ত হয়েছে, তার মধ্যে কত শতাংশের ক্ষেত্রে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে,
(৩) তদন্ত হওয়া ঘটনার কত শতাংশের ক্ষেত্রে দোষীর কাছ থেকে টাকা বা সম্পত্তি উদ্ধার করা হয়েছে,
(৪) বিচারের আওতায় আসা মামলার কত শতাংশের ক্ষেত্রে দণ্ডাদেশ বলবৎ হয়েছে এবং
(৫) বিচারাধীন বা জামিনপ্রাপ্তদের মধ্যে কত শতাংশের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। এই পরিসংখ্যান ও সমীক্ষার পদ্ধতি নিয়ে বিশদ জানতে হলে লভীশ ভান্ডারীর সঙ্গে যৌথ ভাবে প্রণীত আমার ‘কোরাপশন ইন ইন্ডিয়া: দ্য ডিএনএ অ্যান্ড দি আরএনএ’ (কোনার্ক, ২০১১) দেখতে পারেন।
এই সমীক্ষা থেকে কিছু সামগ্রিক সিদ্ধান্ত করা যেতে পারে। সরকারি দুর্নীতি দমনে নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে অন্ধ্রপ্রদেশের সাফল্য ছিল চোখে পড়ার মতো। গত কয়েক বছরে বিহার এবং গুজরাত অন্য রাজ্যগুলির চেয়ে অনেকটা ভাল কাজ করেছে। হরিয়ানাও আগে অনেক বেশি সফল হয়েছিল। তামিলনাড়ু এবং মধ্যপ্রদেশ ক্রমশ উন্নতি করেছে, তবে উন্নতির হার শ্লথ। উত্তরপ্রদেশের হাল আগে খুব খারাপ ছিল, এখন তুলনায় ভাল হচ্ছে। কেরলও ক্রমশ উন্নতি করছে। পঞ্জাব অনেক দিন একই জায়গায় আটকে ছিল, ইদানীং কিছুটা ভাল করেছে। মহারাষ্ট্র নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে একেবারে উপরের সারিতে ছিল, তার পর থেকে চোখে পড়ার মতো অবনতি হয়েছে। সরকারি কর্মীদের দুর্নীতি নিবারণের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ অতীতেও পিছিয়ে ছিল, গত দু’দশকে আরও অবনতি হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের স্থান অন্য সব ক’টি বড় মাপের রাজ্যের পিছনে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র তথ্য বিশ্লেষণ করলে একটা ব্যাপার চোখে পড়ে। সাধারণত রাজ্যে সরকার বদলালে দুর্নীতি দমনের তৎপরতা কিছুটা বাড়ে। কিন্তু তার পর আবার সব থিতিয়ে যায়।
প্রশাসনিক সংস্কার কমিশনের চতুর্থ রিপোর্টটির কথা আমি আগেই লিখেছি। এই রিপোর্টে অনেক মূল্যবান কথা আছে। বিশেষত, ছোটখাটো দুর্নীতি নিবারণের জন্য রিপোর্টে কিছু প্রস্তাব ছিল। এখানে কয়েকটির কথা বলব। সরকারি টাকা নয়ছয় করা এবং ন্যায়বিচারের পথে বাধা সৃষ্টি করার অপরাধগুলি দুর্নীতি নিবারণ আইনের আওতায় পড়ে। চতুর্থ রিপোর্টে বলা হয়েছিল, এই আইনের সাত নম্বর ধারা সংশোধন করে ‘কলিউসিভ ব্রাইবারি’ অর্থাৎ ‘যোগসাজস-ভিত্তিক দুর্নীতি’কে একটি নির্দিষ্ট অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা দরকার। তা ছাড়া সুপারিশ ছিল: সরকারি কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা করার আগে সরকারি অনুমতি নেওয়ার নিয়ম কিছু কিছু ক্ষেত্রে পালটানো চাই, সরকারি কর্মীদের দুর্নীতি প্রমাণিত হলে ক্ষতিপূরণ আদায়ের নিয়ম থাকা উচিত। এই সব মামলার দ্রুত বিচারের ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল। যে সব বেসরকারি সংস্থা জনপরিষেবা দেয় এবং যে সব এন জি ও ভাল রকমের সরকারি অনুদান পায়, তাদেরও পি সি এ’র আওতায় আনতে বলেছিল সংস্কার কমিশন। এ ছাড়াও অনেক মূল্যবান সুপারিশ ছিল চতুর্থ রিপোর্টে।
শেষে বলতে হয়, বড় আকারের দুর্নীতির তুলনায় জনপরিষেবা সরবরাহের ক্ষেত্রে সংঘটিত দুর্নীতি আটকানো তুলনায় সহজ। একচেটিয়া কর্তৃত্ব এবং যথেচ্ছ সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার খর্ব করে, জনপরিষেবা সরবরাহের ব্যবস্থায় বিকেন্দ্রীকরণ এনে, নানা ধরনের রক্ষাকবচের বন্দোবস্ত করে এবং (পি সি এ’র সংশোধন করতে না পারলেও) একটা বিশ্বাসযোগ্য দুর্নীতি-প্রতিরোধী ব্যবস্থা তৈরি করে দৈনন্দিন দুর্নীতির প্রকোপ কমানো সম্ভব। তা করা হবে কি না, সেটা অবশ্যই রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রশ্ন।

দিল্লিতে সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ-এ অর্থনীতিবিদ


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.