|
|
|
|
সাক্ষাৎকার ... |
|
নরেন্দ্র মোদী মোটেও ভাল প্রশাসক নন
গুজরাতে শিল্পপতিরা ভিড় করেন কারণ মোদী তাঁদের অনেক রকম ছাড় দেন।
সেটা ভর্তুকি। এক দিকে আমি গরিবের জন্য ভর্তুকির বিরোধিতা করব, অন্য দিকে
সবচেয়ে বড়লোকদের ঢেলে ভর্তুকি দেব, এই দ্বিচারিতাকে সুশাসন বলতে প্রবল
আপত্তি রয়েছে। বললেন অর্থনীতিবিদ প্রণব বর্ধন। তাঁর সঙ্গে কথায় অমিতাভ গুপ্ত। |
|
এ বারের লোকসভা নির্বাচনের লড়াইয়ে অর্থনীতির তর্ক একটা বড় জায়গা জুড়ে আছে। ইউপিএ মানে পুনর্বণ্টনের মাধ্যমে উন্নয়ন আর নরেন্দ্র মোদী মানে সুশাসন এমন একটা ছক মেনে তর্ক চলছে। জগদীশ ভগবতী, অমর্ত্য সেনরাও সেই তর্কে জড়িয়ে গিয়েছেন। আপনি কী ভাবে দেখছেন?
প্রথমত, অমর্ত্য সেন = ইউপিএ আর জগদীশ ভগবতী = নরেন্দ্র মোদী, এই সরলীকরণে আমি বিশ্বাসী নই। দ্বিতীয়ত, ইউপিএ মানেই শুধু পুনর্বণ্টন আর মোদী মানেই বৃদ্ধি ও সুশাসন, আমি সেটাও মানি না। কেন মানি না, সে প্রসঙ্গে পরে আসব। আপাতত ভগবতীর যুক্তির কথা বলি। তিনি মনে করেন, অর্থনৈতিক সংস্কার হলেই আয়বৃদ্ধি হবে, এবং আয়বৃদ্ধি হলেই গরিবের উন্নতি হবে। দুটো ধাপ নিয়েই প্রশ্ন আছে। প্রথম কথা, সংস্কার হলেই আয় বাড়ে না। দেখতে হবে, কোন ধরনের সংস্কার। ভারতে এত দিন যে সংস্কার হয়েছে, তা মূলত বাণিজ্য নীতির সংস্কার এবং শিল্পক্ষেত্রে সংস্কার। দুটোই আয়বৃদ্ধিতে খানিক প্রভাব ফেলেছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি প্রভাব ফেলতে পারে পরিকাঠামোর সংস্কার। যেমন, বিদ্যুৎ। যদি চুরি নিয়ন্ত্রণ করা যায়, মাসুল বাড়িয়েও বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়মিত ও পর্যাপ্ত করতে পারলে ছোট ছোট শিল্পের ক্ষেত্রে তার বিপুল ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। ভারতে ২০০৩ সালে বিদ্যুৎ আইন তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তার পরের দশ বছরেও ওই আইন কার্যকর করে সংস্কার কিছুই হয়নি। কাজেই, কোন ধরনের সংস্কার হচ্ছে, এই প্রশ্নটা ভুলে গেলে চলবে না।
আর্থিক বৃদ্ধি হলেই গরিব মানুষের উন্নতি কী করে হবে? ভগবতী দুটো পথের কথা বলেন। প্রথমটা প্রত্যক্ষ পথ। আয়বৃদ্ধি হলে প্রচুর চাকরি তৈরি হবে, তাতে অনেকে চাকরি পাবেন, এবং তাতে তাঁদের উন্নতি হবে। দ্বিতীয়, মানে পরোক্ষ পথটি হল, আয়বৃদ্ধি হলে সরকার বেশি কর আদায় করতে পারবে, আর সেই টাকায় গরিব মানুষের উন্নতি হবে। ভারতে যখন চড়া হারে আয়বৃদ্ধি হয়েছে, তখনও সেই অনুপাতে কর্মসংস্থান হয়নি। কেন, সেই কারণের মধ্যে এখন ঢুকছি না, কিন্তু ভারতে আয়বৃদ্ধি চিরকালই প্রযুক্তি, পুঁজি ও দক্ষতানিবিড়। শ্রমনিবিড় কখনও নয়। গুজরাতের আয়বৃদ্ধি নিয়ে যে এত কথা হয়, সেখানেও তো আয়বৃদ্ধি হয়েছে মূলত পেট্রোরসায়ন শিল্পকে কেন্দ্র করে। রিলায়েন্স আর এসার, এই দুটো সংস্থার দৌলতে। সেই শিল্প ভয়ানক প্রযুক্তি ও পুঁজিনিবিড়। প্রত্যক্ষ পথটা শুনতে যত ভাল, ততটা বাস্তবে নয়।
আর, সরকারের হাতে করের টাকা বাড়লে সেই টাকা কোথায় যায়? হিসেব বলছে, গরিব মানুষের উন্নতিতে সরকার যত টাকা খরচ করে, তার বহু গুণ ব্যয় করে মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তদের ভর্তুকি দিতে। আমাদের দেশে বড়লোকরা রাজনৈতিক ভাবে এত শক্তিশালী যে সরকারের হাতে টাকা থাকলে তার সিংহভাগ তারাই কেড়ে নেয়। অমর্ত্য সেনরা যে পুনর্বণ্টনের কথা এত জোর দিয়ে বলেন, সেটা, আমার ধারণা, মূলত এই প্রবণতা আটকাতেই। গরিব মানুষের গলা তো এমনিতে শোনা যায় না। অমর্ত্য সেনরা তাঁদের গলার জোর বাড়াচ্ছেন।
কিন্তু, অর্থনীতি নিয়ে যতই তর্ক হোক, নির্বাচনে কি আদৌ আর্থিক নীতির কোনও প্রভাব পড়ে? এই যে চারটে বড় রাজ্যে নির্বাচন হয়ে গেল, তার ফলাফল দেখে তো অনেকেই বলছেন যে মানুষ কল্যাণ অর্থনীতিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
আমার মনে হয়, এটা একটু তাড়াহুড়ো করে সিদ্ধান্তে পৌঁছনো হচ্ছে। সরকার সুবিধা দিলে মানুষ সেটা চায় না, এটা আমার মনে হয় না। যে রাজ্যে তেমন শিল্প নেই, কৃষির রোজগারেও সংসার চলে না, সেখানে তো বেঁচে থাকার জন্যই সরকারি প্রকল্পের প্রয়োজন। মধ্যপ্রদেশের শিবরাজ সিংহ চহ্বাণ জিতেছেন মূলত তাঁর কল্যাণ নীতির জন্যই। ছত্তীসগঢ়ে গণবণ্টন ব্যবস্থা ঠিক ভাবে কাজ না করলে রমন সিংহ এই নির্বাচনে জিততেন বলে মনে হয় না। ছত্তীসগঢ়ে গণবণ্টন ব্যবস্থার সাফল্যের একটা বড় কারণ রেশন দোকানগুলোকে ব্যক্তিমালিকানা থেকে সরিয়ে পঞ্চায়েত বা গ্রামীণ গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়ার ফলে। এটা কিন্তু রমন সিংহের সিদ্ধান্ত নয়। এটা করেছিলেন কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী অজিত যোগী। কাজেই, ইউপিএ-র কল্যাণনীতি মানুষ প্রত্যাখ্যান করছে, এটার কোনও প্রমাণ নেই।
অশোক গহলৌতের কথা তুলতে পারো। অনেকেই বলছেন, গহলৌত নিখরচায় ওষুধ বিলির সিদ্ধান্ত করেও নির্বাচনে ভরাডুবি এড়াতে পারলেন না। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত তো হয়েছে নির্বাচনের সপ্তাহতিনেক আগে। মানুষের হাতে ওষুধ পৌঁছনোর সময় পাওয়া গেল কোথায়? এটা জরুরি। মানুষ সিদ্ধান্ত দেখতে চায় না, পরিষেবা পেতে চায়। কাজেই গহলৌতের উদাহরণটা এখানে খাটবে না। আর তা ছাড়া, রাজস্থানে কংগ্রেসের ভরাডুবির পিছনে অন্তর্দ্বন্দ্বের বড় ভূমিকা আছে বলেই শুনেছি। |
|
মোদীর প্রচারের মূল হল সুশাসনের প্রতিশ্রুতি। প্রশাসক হিসেবে তিনি কতটা সফল?
মোদী নিশ্চয়ই কিছু কাজ ভাল ভাবে করেছেন। তাঁর আমলে গুজরাতে বিদ্যুৎ পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে। চটজলদি সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও তাঁর বেশ দক্ষতা রয়েছে। সেটা তাঁর কাজের ধরনের মধ্যেই পড়ে। রাস্তাঘাট অবশ্য অনেক দিন থেকেই ভাল ছিল। কিন্তু, তাঁকে ঘিরে যে বৃদ্ধির চড়া হারের গল্প, সেটাকে ভাল করে বিশ্লেষণ করা দরকার। যদি গত চল্লিশ বছরের পরিসংখ্যান দেখো, গোটা দেশে শিল্পে গুজরাত দ্বিতীয় স্থানে আছে। প্রথম মহারাষ্ট্র। চল্লিশ বছর আগেও তা-ই ছিল, এখনও আছে। তার মানে, গুজরাতে শিল্পের বৃদ্ধি হয়েছে কিন্তু মহারাষ্ট্রেও ভালই হয়েছে। মোদীর বিশেষ কৃতিত্ব কোথায়? তিনি তো গত বারো-তেরো বছরে গুজরাতকে এক নম্বরে নিয়ে যেতে পারেননি।
কিন্তু সেটা জরুরি কথা নয়। সুশাসন মানে কী? মুসলমান পিটিয়ে আর্থিক হার বাড়ালাম, এটা তো সুশাসন হতে পারে না। তাঁর রাজ্যের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা তাঁর দায়িত্ব ছিল। তিনি সেই কাজে চূড়ান্ত ব্যর্থ। অটলবিহারী বাজপেয়ী ‘রাজধর্ম’ থেকে মোদীর বিচ্যুতির কথা বলেছিলেন। এখনও শুনছি উনি গুজরাতে বৃদ্ধির কথা বলছেন, আর অন্য দিকে তাঁরই দক্ষিণ হস্ত যে ব্যক্তিটিকে তিনি উত্তরপ্রদেশের রাজনীতির দেখাশোনার জন্য পাঠিয়েছেন সে ব্যক্তি সেখানে গিয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়াচ্ছেন। প্রশাসনের অন্যান্য না ব্যাপারেও মোদীর স্বেচ্ছাচারী স্টাইলের কথা গুজরাতে অনেকেই বলেছেন। আমি তাই তাঁকে প্রশাসক হিসেবে বেশ খারাপ বলব। অর্থনৈতিক প্রশাসক হিসেবেও ওঁর বেশ কিছু ত্রুটি আছে। গুজরাতে শিল্পপতিরা ভিড় করেন কারণ মোদী তাঁদের অনেক রকম ছাড় দেন, সুবিধা দেন। সেটা ভর্তুকি। এক দিকে আমি গরিব মানুষের জন্য ভর্তুকির বিরোধিতা করব, আর অন্য দিকে সবচেয়ে বড়লোকদের ঢেলে ভর্তুকি দেব, এই দ্বিচারিতাকে সুশাসন বলতে আমার প্রবল আপত্তি রয়েছে।
সুশাসনের উদাহরণ হিসেবে আমি বরং তামিলনাড়ু আর হিমাচল প্রদেশের কথা বলব। এই দুটো রাজ্যে যেমন আর্থিক বৃদ্ধি হয়েছে, তেমনই কল্যাণমূলক কাজও হয়েছে অনেক। তামিলনাড়ুতে আয়বৃদ্ধির হার গুজরাতের চেয়ে খুব কম নয়। কাজেই, আমি গুজরাতের চেয়ে এই রাজ্য দুটোকে এগিয়ে রাখব। খালি নিজেকে বিকাশপুরুষ বলে নিজের ঢাক পেটালেই মোদী এই সত্যটাকে চাপা দিতে পারবেন না।
কিন্তু, সুশাসনের প্রশ্নে ইউপিএ-র রেকর্ড তো খুবই খারাপ। এই আমলে যে পরিমাণ দুর্নীতি হয়েছে, সেটা কি সরকারের ব্যর্থতা নয়?
এই সরকারের আমলে নানা কেলেঙ্কারির কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। তবে প্রশ্নটাকে একটু অন্য ভাবে দেখাও প্রয়োজন। যখন আর্থিক কর্মকাণ্ড বাড়ে, তখন বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদের চাহিদাও বাড়ে। ফলে, সেগুলো ক্রমশ বহুমূল্যবান হয়ে ওঠে। যেমন কয়লা, বিভিন্ন খনিজ আকরিক ইত্যাদি। এবং, তখনই মুনাফার লোভে তাতে বহু লোক আকৃষ্ট হয়। মাফিয়াচক্র তৈরি হয়। এটা একেবারে অর্থনীতির যুক্তি। ইউপিএ-র বদলে এনডিএ থাকলেও এটাই হত। বেঙ্গালুরুতে যে খনি মাফিয়া তৈরি হয়েছিল, সেটা তো বিজেপি-র আমলে। মুম্বইতে এখন আদর্শ কেলেঙ্কারি হচ্ছে। শিবসেনার আমলেও জমি নিয়ে একই রকম দুর্নীতি হয়েছে। বস্তুত, গোটা দেশেই সাম্প্রতিক কালে জমি সংক্রান্ত দুর্নীতি বেড়েছে, মাফিয়ার রমরমা হয়েছে (পশ্চিমবঙ্গে যেমন এই মাফিয়া বাম আমলেও ছিল, এখনও আছে)। জমি তো অনন্ত কাল ধরেই ছিল। কিন্তু এখন বিভিন্ন কারণে তার দাম বেড়েছে, ফলে দুর্নীতিও বেড়েছে। কাল যদি ইউপিএ-র বদলে কেন্দ্রে এনডিএ-র সরকার আসে, এই ছবিটা সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাবে না। এটা রাজনীতির প্রশ্নই নয়। এটা অর্থনীতির টানাপোড়েনের খেলা। সেটা তো রাতারাতি বদলাবে না। চুরি-ডাকাতি একই রকম থাকবে।
সরকার যদি সত্যিই বদলায়, মোদী যদি দেশের প্রধানমন্ত্রী হন, আপনার প্রতিক্রিয়া কী হবে?
সুষ্ঠু নির্বাচনে দেশের জনসাধারণ ভোট দিয়ে যদি এনডিএ-র সরকারকে জেতায়, এবং সেই সরকারের মুখ্য নেতা হিসেবে মোদী যদি প্রধানমন্ত্রী হন, সেই গণতান্ত্রিক রায় শিরোধার্য। কিন্তু তাই বলে মোদী সম্পর্কে আমাদের ব্যক্তিগত মত রাতারাতি পাল্টাবে না। সুশাসন নিয়ে মোদী সম্পর্কে একটু আগে যা বলেছি, সেই মতও আমার বদলাবে না, যদি না প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি এ ব্যাপারে বড় গোছের কোনও পরিবর্তন দেখাতে পারেন। সুশাসনের ব্যাপার ছাড়াও একটা ব্যক্তিত্বের ঝোঁকের ব্যাপারও রয়েছে। বিখ্যাত মনস্তত্ত্ববিদদের লেখায় ‘অথরিটারিয়ান পার্সোনালিটি’ বা স্বেচ্ছাচারী ধাঁচের ব্যক্তিত্ব নিয়ে অনেক আলোচনা দেখেছি। মোদীর সঙ্গে আমার পরিচয় নেই, কিন্তু লোকমুখে যা শুনেছি, মোদীর ব্যক্তিত্ব অনেকটা ওই ধরনের। বছর দুই আগে একটি পত্রিকায় প্রচুর খেটে, প্রচুর তথ্য জোগাড় করে মোদীর ওপর একটা লম্বা প্রবন্ধ লিখেছিলেন সাংবাদিক বিনয় হোসে। ওই লেখা পড়লে বুঝতে পারবে, মোদীর ব্যক্তিত্বের যে ধাঁচটার কথা আমি বলছি, সেটা আসলে কী। এই ধাঁচটা গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণার পরিপন্থী। এই ব্যক্তিত্বের কারণে গুজরাতে মুসলমান নিধনের ইতিহাস না থাকলেও মোদী সম্পর্কে যথেষ্ট চিন্তার কারণ থাকত। সমস্যা হয়েছে যে আমাদের ধনী ও উচ্চমধ্যবিত্ত সমাজে (এবং তাঁদের তল্পিবাহক কিছু সংবাদমাধ্যমেও) এই ধরনের ব্যক্তিত্বের একটা চাহিদা আছে, এই ধরনের নেতার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ভারত কবে সুপারপাওয়ার হিসেবে ‘জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে’, তার জন্য তাঁরা অধৈর্য হয়ে উঠেছেন। অটলবিহারী বাজপেয়ীর সঙ্গে আমার এক বার অনেক ক্ষণ কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। আমি ওঁর দলকে তখনও সমর্থন করতাম না, এখনও করি না কিন্তু বাজপেয়ীর মধ্যে এই স্বেচ্ছাচারী ব্যক্তিত্বের কোনও লক্ষণ দেখিনি। |
|
|
|
|
|