ক্রিকেট নামক ঔপনিবেশিক খেলাটিকে প্রাপ্যের বহু গুণ গুরুত্ব দেওয়া ভারতের অভ্যাস। অভ্যাসটি গত তিন দশকে বাড়িয়া উঠিয়াছে কপিল দেবের নেতৃত্বে বিশ্বকাপ জয়ের পর। এই গুরুত্ববৃদ্ধি যে নিতান্তই অহেতুক, তাহা বলিবার উপায় নাই। সাফল্য অপেক্ষা বড় বিজ্ঞাপন আর হয় না। হকি নামক খেলাটিতে ভারতীয় দল একদা সফল ছিল, ফলে খেলাটিও জনপ্রিয় ছিল। পশ্চিম দুনিয়া সেই খেলাটিকে আমূল বদলাইয়া দিয়াছে। ভারতীয় দল সেই বদলের চরিত্র রপ্ত করিতে পারে নাই। সাফল্যও কমিতে কমিতে এক সময় শূন্যে মিলাইয়া গিয়াছে, জনপ্রিয়তা তাহাকে অনুসরণ করিয়াছে। ক্রিকেটে ভারতীয় দল সফল, অতএব খেলাটিকে ‘ধর্ম’ বলিতেও ভারতীয়দের বাধে না। প্রশ্ন হইল, সেই সাফল্যের চরিত্র কী? উপমহাদেশের ‘পাটা’ উইকেটে ভারতীয় দল অতি সফল। বৎসর দুই পূর্বে ইংল্যান্ড আসিয়া এই উইকেটেই ধোনি বাহিনীকে পর্যুদস্ত করিয়া গিয়াছিল বটে, কিন্তু তাহা ব্যতিক্রম। ব্যাটিং সহায়ক ও স্পিন-বান্ধব উইকেটে ভারতীয় দলের দাপট প্রবল। কিন্তু বিদেশের সবুজ উইকেটে ভারতীয় ক্রিকেটারদের অসহায়তাও একই রকম সত্য ও প্রায় ব্যতিক্রমহীন। সুনীল মনোহর গাওস্কর হইতে বিরাট কোহলি, বিভিন্ন পর্বে এক এক জন ব্যাটসম্যান দেশে-বিদেশে সমান সফল হইয়াছেন বটে, কিন্তু ক্রিকেট খেলাটি এগারো জনের। কাজেই, ভারতীয় ক্রিকেট দলের সাফল্যের উপাখ্যানে একটি পাদটীকা অনপনেয়: ঘরের সাফল্যের প্রতিফলন বাহিরে ঘটে নাই। ঘটিবে যে, তেমন আশাও দূরপরাহত।
তবে, ভাবিয়া দেখিলে, ভারতীয় দল যেমন কেবল ঘরের মাঠে জিতিতেছে, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা বা নিউজিল্যান্ডের ন্যায় দেশগুলিও ঠিক তাহাই করিতেছে। তাহারাও তো উপমহাদেশের উইকেটে হাবুডুবুই খায়। অবশ্য, ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড গোটা দুনিয়ায় যে ভঙ্গিতে ছড়ি ঘুরায়, তাহার সহিত এই ঘরে-বাহিরের দ্বিত্ব ঠিক সঙ্গতিপূর্ণ নহে। এই পরিস্থিতিতে ভারতীয় দলের করণীয় কী? এক, এই অবস্থাটিকেই ‘স্বাভাবিক’ বলিয়া স্বীকার করিয়া যেমন চলিতেছে, চলিতে দেওয়া। ভারতীয় বোর্ড সম্ভবত এই পথেই হাঁটিবে। দ্বিতীয় পথ হইল ঘরের এবং বাহিরের জন্য দুইটি পৃথক দল তৈরি করা। বাহিরের দলটির প্রশিক্ষণ অস্ট্রেলিয়া বা দক্ষিণ আফ্রিকার ন্যায় দেশের মাটিতে হওয়াই বাঞ্ছনীয়। ভারতীয় বোর্ডের অর্থের অভাব নাই, ফলে এই কাজটি দুঃসাধ্য নহে। তবে, এই পথটি কঠিন। সস্তায় বাজিমাতের ইচ্ছা থাকিলে তৃতীয় বিকল্প লইয়া মাথা ঘামাইতে হইবে।
তৃতীয় একটি পথও থাকিতে পারে। ক্রিকেট নামক খেলাটির চরিত্র বদলাইয়া দেওয়া। হকিতে যেমন কৃত্রিম ঘাসে খেলাই এখন নিয়ম হইয়া দাঁড়াইয়াছে, ক্রিকেটেও মাঠের চরিত্র বদলাইয়া দেওয়া যায়। ক্রিকেট-বিশ্বে ভারতই সর্বাধিক ক্ষমতাবান। ভারত দাবি করিতেই পারে, স্পিন সহায়ক উইকেট না হইলে খেলিব না। ভারত না খেলিলে বিজ্ঞাপনও নাই, পয়সাও নাই। ফলে, নতিস্বীকার করা ভিন্ন অন্য দেশগুলির নিকট আর একটিই পথ থাকে: ক্রিকেট খেলা বন্ধ করিয়া দেওয়া। বিশুদ্ধবাদীরা বলিতে পারেন, তাহাতেই বা ক্ষতি কী? উপনিবেশ অতীত হইয়াছে, ঔপনিবেশিক খেলাটিও না হয় অতীতই হইবে। কিন্তু বিনোদনের বাজার সে কথা শুনিবে কেন? এবং, বাজার সর্বশক্তিমান, কারণ তাহা সত্য। |