প্রায় পাঁচ মাস ধরে আধুনিকীকরণের কাজ চলার পরেও কলকাতার ভারতীয় সংগ্রহালয় বা জাদুঘরে পুরাবস্তুর সংরক্ষণে বেশ কিছু ত্রুটি রয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ উঠল প্রথম দিনই।
সদ্য দ্বিশতবর্ষ পালনের উদ্যোগ শুরু হয়েছে জাদুঘরে। তার আগে ১ সেপ্টেম্বর থেকে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত জাদুঘর বন্ধ রেখে সংস্কার ও আধুনিকীকরণ হয়েছে। মঙ্গলবার, সরস্বতী পুজোর দিন সাধারণের জন্য জাদুঘর ফের খুলে দেওয়া হয়। এ দিনই গিয়ে বেশ কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি চোখে পড়েছে বলে দর্শনার্থীদের দাবি।
সংস্কারের কাজ করার সময়েই সংগ্রহালয়ে রামপূর্বার সিংহটি ভেঙে গিয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছিল। জাদুঘর কর্তৃপক্ষ সেই অভিযোগ অস্বীকার করেন। কিন্তু এ বার আধুনিকীকরণের কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার পরেও গিয়ে দেখা যায়, ওড়িশার ললিতগিরি থেকে সংগৃহীত দশম শতাব্দীর বজ্রপাণি, অবলোকিতেশ্বর ও উপবিষ্ট তারার তিনটি মূর্তি পরপর রয়েছে খোলা বারান্দার ধারে। তিনটি মূর্তির গায়েই দেওয়ালে চুনকাম করার সময় রং লেগেছে। একটি মূর্তির এক পাশ দেওয়ালে গেঁথে গিয়েছে। অন্যত্র বেশ কিছু মূর্তি কালো হয়ে গিয়েছে। |
দেওয়ালের ভিতর মূর্তির অংশ। মঙ্গলবার জাদুঘরে। ছবি: দেবস্মিতা চক্রবর্তী। |
এমন কেন হল? সংগ্রহালয়ের তরফে বাসুদেব দাশগুপ্ত জানান, সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত মাত্র ক’মাসের মধ্যে এই বিশাল কর্মযজ্ঞ হয়েছে। কিছু সমস্যা থেকে গিয়ে থাকতে পারে। সেগুলি এখন আলাদা ভাবে নজর দিয়ে ঠিকঠাক করা হবে।
জাদুঘরে গিয়ে এখন প্রথমেই নজর কাড়ে নতুন করে সাজানো বড় টিকিট ঘর। তা পেরিয়ে ঢোকার মুখেই চোখ আটকে যাবে যক্ষী মূর্তিতে। মূর্তিটির নীচের অংশ ধূসর, কিন্তু মুখটি কুচকুচে কালো। গান্ধার গ্যালারিতে মৈত্রেয় বুদ্ধের ডান দিকে কাচের আলমারিতে রাখা একাধিক সুপ্রাচীন বুদ্ধমূর্তির রংও ঘন কালো হয়ে গিয়েছে। পুরাকীর্তি সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞদের অনুমান, মূর্তিগুলির গায়ে সম্ভবত এমন কোনও ক্ষয়নিরোধক রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়েছে, যাতে মূর্তির রঙের পরিবর্তন হয়ে গিয়ে থাকতে পারে। তবে বাসুদেববাবুর বক্তব্য, যে মূর্তিগুলি কালো হয়ে গিয়েছে, সেগুলি অনেক আগে থেকেই কালো হয়ে রয়েছে। তার সঙ্গে এই আধুনিকীকরণের কোনও সম্পর্ক নেই। প্রাকৃতিক বা অন্য কারণে সেগুলির রং পরিবর্তন হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু সংগ্রহালয়ের প্রাক্তন অধিকর্তা অনুপ মতিলাল মনে করছেন, বিষয়টা সম্ভবত এত সরল নয়। “ওই মূর্তিগুলির গায়ের রং কেন কালো হয়ে গেল, তা সত্যিই খতিয়ে দেখা দরকার।”
অতীতে নয়ের দশকে এক বার ভারহূত গ্যালারির কিছু মূর্তিতে কালো রং করা হয়েছিল এবং তা নিয়ে তীব্র সমালোচনা হয়েছিল বলেও মনে করতে পারেন অনুপবাবু। এ দিন জাদুঘরে গিয়ে সাধারণ দর্শনার্থীদের কারও কারও মনেও প্রশ্ন জেগেছে, মূর্তিগুলিতে নতুন করে কালো রং করা হয়েছে কি না। বাসুদেববাবু অবশ্য বলছেন, “কোনও মূর্তি বা অন্য পুরাকীর্তিতে ক্ষয়নিরোধের কাজ ছাড়া অন্য কোনও কাজ করা হয়নি। রং করা তো দূরের কথা।”
ললিতগিরির মূর্তিগুলির দুর্দশার কথা অবশ্য বাসুদেববাবু অস্বীকার করেননি। তিনি বলেন, “যে মূর্তিগুলির গায়ে চুনকামের দাগ দেখা যাচ্ছে বা যা দেওয়ালে গেঁথে রয়েছে, তা অবশ্যই ঠিক করে দেওয়া হবে।” কিন্তু বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এটা শুধু ভুল শুধরে নেওয়ার বিষয় নয়। কর্মপদ্ধতিতে এত বড় ত্রুটি থেকে গেল কী করে, সেটা খতিয়ে দেখা উচিত। পুরাকীর্তি সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞ পার্থরঞ্জন দাস বলছেন, “বিগ্রহগুলি না সরিয়েই দেওয়ালে চুনকাম করা হয়েছে। এমনকী দেওয়ালে গেঁথে দেওয়া হয়েছে মূর্তির অংশ। এটা মারাত্মক অপরাধ।”
গান্ধার গ্যালারিতে মাঝখানে রয়েছে একটি অর্ঘ্য স্তূপ। কাচের উপর দিয়েই দেখা যাচ্ছে, পুরাকীর্তিটির নীচে পড়ে রয়েছে পাথরের গুঁড়ো। বিশেষজ্ঞদের দাবি, সম্ভবত সংস্কারের সময় স্তূপটি টেনে সরানো হয়েছিল ঘরের অন্য পাশে। তখনই সম্ভবত প্রাচীন এই স্তূপের গা থেকে খসে পড়েছে তার কিছু অংশ। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, ভারী পুরাকীর্তি সরানোর সময় নীচে চাকা লাগানো টেবিল ব্যবহার করা উচিত। তা না হলে পুরাকীর্তির এমন ক্ষতি অবশ্যম্ভাবী।
দ্বিশতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে সম্প্রতি এই সংগ্রহালয় ঘুরে দেখেছেন বেশ কয়েক জন ইতিহাসবিদ। এ দিন ছুটির দিনে সাধারণ মানুষের উৎসাহও কম ছিল না। ৫২২৪ জন দর্শনার্থী গিয়েছিলেন জাদুঘরে, যাঁদের মধ্যে ১২৪ জন বিদেশি। কিন্তু দর্শক সমাগমের প্রভাবে পুরাকীর্তিগুলির যাতে ক্ষতি না হয়, তার ব্যবস্থা রয়েছে কি?
ভারহূত গ্যালারিতে গিয়ে দেখা গেল পুরাকীর্তির কোনও আড়াল নেই। জাতকের গল্প খোদিত পাথরের দেওয়াল, দ্বারের গায়ে অনায়াসে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছুটির দিনে ছবি তোলাচ্ছেন বেশ কয়েক জন দর্শক। ক্যামেরা নিয়ে ঢোকা যদিও নিষিদ্ধ, কিন্তু মোবাইলে মুহুর্মুহু ছবি তোলা হচ্ছে গোটা চত্বরেই।
আগে জাদুঘরে কেবল ইংরেজি ও হিন্দিতে পুরাকীর্তির বিবরণ লেখা থাকত। এ বার সেখানে যোগ করা হয়েছে বাংলাও। কিন্তু কোনও কোনও বিবরণের খটমট পরিভাষা ও ভুল বানান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে প্রথম দিনই। যেমন গান্ধার স্তূপের বিবরণে এক জায়গায় লেখা হয়েছে “...তিনভাগে বিভক্ত দীর্ঘীকৃত মেধি ও পদ্মপাপড়ি শোভিত অণ্ড, হর্মিকা ও তার উপরিভাগে ছোট বেদিকা সহ ভিত্তি এবং ছত্রাবলী সমেত পুরো স্তূপটি একটি বড় বেদিকা সহ ভিত্তি আসনে স্থাপিত...।” অনুপবাবুর মতো অনেকেই বলছেন, “সাধারণের বোঝার সুবিধার জন্য বাংলায় বিবরণ যখন লেখাই হল, তখন আর একটু সহজবোধ্য ভাষা আর সঠিক বানানের দিকে নজর রাখা উচিত ছিল না কি?” |