সরস্বতীর বাহন এখানে হাঁস নয়। বনের রাজা বাঘ। তা-ও একটা নয়, এক জোড়া বাঘ। এখানেই শেষ নয়। সরস্বতীর এক পাশে রয়েছেন মহালক্ষ্মী। অন্য পাশে রাজলক্ষ্মী। সঙ্গে রয়েছেন জয়া, বিজয়া। এবং আরও কয়েকটি পরী। দুর্গাপুজোর মতো একচালায় এতগুলি প্রতিমা নিয়ে এমনই এক ভিন্ন আঙ্গিকের সরস্বতী পুজোয় মাতে দুবরাজপুরের খোসনগর গ্রাম। শতাব্দী প্রচীন এই পুজোয় শুধু প্রতিমা বা পুজোর রীতিতেই ভিন্ন নয়, সরস্বতীর জন্য রয়েছে একটি পৃথক মন্দিরও। তত্কালীন গ্রামের জমিদার ঘোষেদের ১৩০ বছর আগে তৈরি সেই মন্দির এখন ভগ্নপ্রায়। পুজোটি এখনও গ্রামের ওই জমিদার পরিবারের বংশধরদের প্রায় ২৫ ঘর শরিকের। তবুও গ্রামের সব চেয়ে প্রাচীন ওই মন্দিরের গঠনশৈলী, কারুকার্য, ঐতিহ্য এবং সরস্বতী পুজো নিয়ে গর্বিত গ্রামের প্রত্যেকেই। তাই গ্রামের ১১৫টি পরিবারের সরস্বতী পুজো বলতে ওই একটিই। |
চলছে আরাধনা। —নিজস্ব চিত্র। |
বর্তমান শরিক নৃপেন্দ্রমোহন ঘোষ, রথীন পাল, রতন পাল ও নিমাই ঘোষেরা জানান, আজ থেকে ঠিক ১৪০ বছর আগে ১২৮১ বঙ্গাব্দে তাঁদের পূর্বপুরুষেরা শাল নদীর ধার ঘেঁষা এই খোসনগর গ্রামে সরস্বতী পুজোর প্রচলন করেন। পুজো প্রচলনের ৯ বছর পরে তৈরি হয় সরস্বতী মন্দির। বেশ কয়েক বছর ধরে অত্যন্ত যত্নে তৈরি ইট, চুন, সুরকির সেই মন্দিরে এখন অসংখ্য ফাটল। ছাদও ধসে পড়েছে। সরস্বতী প্রতিমা বসার জায়গায় মাথার উপরে দেওয়া হয়েছে টিনের চাল। তবুও যেটুকু অবশিষ্ট রয়েছে, তা এখনও নজর কাড়ে। কিন্তু কী কারণে প্রতিমার এমন আঙ্গিক, সেটা অবশ্য ঠিকমতো বলতে পারেননি বর্তমান শরিকেরা। তবে গ্রামে একটি প্রচলিত প্রবাদ রয়েছে। পৌষ মাসের এক বৃহস্পতিবার নাকি সরস্বতী মন্দিরে বাঘ এসেছিল। সেই থেকেই দেবীর বাহন হাঁসের বদলে বাঘ। আর সরস্বতী প্রতিমার পাশে অন্য দুই দেবীর উপস্থিতি হয়েছে, দুবরাজপুর হেতমপুর রাজবাড়ির সরস্বতী প্রতিমার আদলের জন্যই। কারণ, গ্রামের জমিদারেরা ছিলেন হেতমপুর রাজাদের সমসাময়িক।
নৃপেন্দ্রমোহনরা বলছেন, “যথেষ্ট বড় এই গ্রামের অনেকেই বহু বছর আগে কলেরা ও বন্যার ভ্রূকুটির জন্য গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়েছেন। ছ’ পুরুষ আগের সেই জমিদারি এখন অতীত। যেটুকু সম্পত্তি ছিল, তা বংশ পরম্পরায় ভাগ হতে হতে প্রত্যেকের দখলেই খুব সামান্যই এসেছে।” তাঁর দাবি, গ্রামের পরিবারগুলি মূলত কৃষি নির্ভর। এক দিকে, আর্থিক অভাবে অন্য দিকে, সকলের ঐক্যমত না হওয়াতেই ওই প্রাচীন মন্দিরের সংস্কার করা যায়নি। ফলে যত্নের অভাবে এবং নীচের মাটি বসে গিয়ে ওই মন্দির জীর্ণপ্রায় হয়ে গিয়েছে। তবে সরস্বতী পুজোর এই চার দিন সে সব ভুলে সকলেই সমান ভাবে আনন্দে মেতে ওঠেন। প্রথা অনুযায়ী সেই আনন্দে শরিক হন গোটা গ্রামই।
মঙ্গলবার সকালে ওই গ্রামে গিয়ে সকলের উত্সাহ দেখে অন্তত তেমনটাই মনে হল। রংবেরঙের পোশাক পরে মন্দিরে ভিড় জমিয়েছে দ্বীপ, দেবকান্ত, রিয়া, সাধনার মতো স্কুল পড়ুয়ারা। বাচ্চাদের সঙ্গে উপস্থিত গ্রামের বধূরাও। অনেকেই অপেক্ষায় পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার জন্য। কেউ কেউ আবার বাচ্চাদের নিয়ে এসেছেন হাতে খড়ি দেওয়াতে। সকলেই বলছেন, “সরস্বতী পুজোর এই চার দিন খুব আনন্দে কাটে। মেলা বসে, যাত্রা হয়। সকলে একসঙ্গে মিলে উপভোগ করি।” এ বার যদিও যাত্রার বদলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছে। তবে, পুজোর দিন সকালের দিকটা গ্রামের মহিলাদের উপস্থিতি তুলনায় কম। কারণ শীতলাষষ্ঠীর বা সিজানোর জন্য গ্রামের অধিকাংশ পরিবারেই চলছে রান্নাবান্নার তোড়জোড়। সেই কারণেই বাড়ির মহিলাদের এত ব্যস্ততা। তবে রান্না শেষ হলেই সবার গন্তব্য কিন্তু এই সরস্বতী মন্দিরই। |