আগে এক বার সংস্কার হয়েছিল। কিন্তু তা এমন নিম্নমানের ছিল যে সংস্কারের কয়েক বছরের মধ্যেই ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছিল। তার জন্য ২০১২ সালে ফের সংস্কারের কাজ শুরু করা হয়। কিন্তু ১৪ মাস পরেও তার কাজ শেষ হয়নি। কাজ হয়েছে মাত্র ২০ শতাংশ। জেলা সদরের প্রায় ৬২ বছরের পুরনো রবীন্দ্র সদনের পুনর্সংস্কারের কাজের গতি দেখে ক্ষুব্ধ জেলার সাংস্কৃতিক কর্মীরা। অথচ এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ হল এত দিন ধরে বন্ধ থাকায় সমস্যায় পড়েছে বিভিন্ন শিল্প-সাংস্কৃতিক সংস্থাই। সিউড়ির ‘চিরন্তন’ নাট্যগোষ্ঠীর কর্ণধার দেবাশিস দত্ত বলছেন, “জেলার এমন একটি ঐতিহ্যবাহী হলের সংস্কারের কাজে যেন একটু বেশিই সময় লাগছে। জেলা প্রশাসনের উচিত সংস্কারের কাজ যাতে দ্রুত শেষ হয়, তার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া।” |
কবে খুলবে? মঙ্গলবার সিউড়িতে হলের সংস্কারের কাজের এই ছবি তুলেছেন তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়। |
প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, ঠিক ভাবে রবীন্দ্র সদন সংস্কারের জন্য প্রাথমিক ভাবে পূর্ত দফতরের সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট আর্কিটেক্ট চিন্ময় ঘোষ স্থানীয় নাট্যকর্মীদের নিয়ে একটি আলোচনা করেছিলেন। সেখানে নাট্যকর্মীরা মঞ্চ নিয়ে তাঁর কাছে বেশ কয়েকটি প্রস্তাব রেখেছিলেন। চিন্ময়বাবু মূলত সেই প্রস্তাবগুলি মাথায় রেখে রবীন্দ্র সদনের মূল মঞ্চের নকশা তৈরি করেছেন বলে জানা গিয়েছে। কাজ হচ্ছে দু’টি ভাগে ‘সিভিল’ ও ‘ইলেকট্রিক্যাল’। প্রথম ভাগে তৈরি হচ্ছে মূলমঞ্চ। এ ক্ষেত্রে মঞ্চ আগের তুলনায় আরও ১৪ ফুট এগিয়ে এসেছে। বর্ষায় যাতে কোনও ভাবেই দর্শক আসন জলে ডুবে না যায় তার জন্য হলের মেঝের উচ্চতাও বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু গত ১৪ মাসে আমূলে হল সংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ বহু কাজই এখনও বাকি। এক, মূল মঞ্চের বেদি হলের মেঝে থেকে তিন ফুট উচ্চতায় তোলা। দুই, মূল মঞ্চের কাঠের প্ল্যাটফর্ম। তিন, হলের ‘ওয়াল প্যানেলে’ অত্যাধুনিক ডেকোরেটিভ অ্যাকুয়েস্টিকস্ বোর্ড লাগানো। চার, উপর-নীচ মিলিয়ে মোট ৪৫৮টি দর্শকাসন তৈরি করতে হবে। পাঁচ, আধুনিক গ্রিন রুম। ছয়, হলে র্যাম্পের ব্যবস্থা। সাত, পুরনো ফলস্ সিলিং ও টিনের শেড খুলে নতুন লাগানো। এ ছাড়া বেদি থেকে মূল মঞ্চের উচ্চতা বৃদ্ধি, রবীন্দ্র সদনের ভিতরে পানীয় জল ও শৌচালয় তৈরির মতো কাজও বাকি রয়েছে।
এ দিকে, ‘ইলেকট্রিক্যাল’ বিভাগে যা হওয়ার কথা, তার বিন্দুমাত্র কাজও এগোয়নি বলেই অভিযোগ। রবীন্দ্র সদনকে একটি অত্যাধুনিক হল গড়ে তোলার জন্য হলের ভিতরের সাউন্ড ও আলোর উপযুক্ত ব্যবস্থা তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তার মধ্যে আছে মাল্টি পার্পাস অডিও সিস্টেম, মডার্ন স্টেজ লাইট, কম্পাউন্ড লাইট প্রভৃতি। গোটা হলটিতেই সেন্ট্রাল এসি থাকবে। কিন্তু ওই সব কাজের কোনওটিই এখনও শুরুই হয়নি। সংস্কারের কাজের ঢিমেতালে ক্ষুব্ধ জেলার নাট্যপ্রেমী ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। কিন্তু তাতেও হাল তেমন কিছু বদলায়নি। ফলে সমস্যা মিটছে না শিল্পসংস্থাগুলির।
কেন এই ঢিমেতাল?
প্রশাসন সূত্রে খবর, বরাদ্দ নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। রবীন্দ্র সদনের জন্য সিপিএমের সীতারাম ইয়েচুরি সাংসদ কোটা থেকে ১ কোটি ১৫ লক্ষ টাকা দিয়েছেন। তা ছাড়া রাজ্য সরকারও দিয়েছে ৫২ লক্ষ টাকা। কিন্তু তারপরেও কাজ এগোয়নি ঠিক গতিতে। পূর্ত দফতরের তত্ত্বাবধানে বর্ধমানের একটি ঠিকাদার সংস্থা ওই কাজ করছে বলে জানা গিয়েছে। কিন্তু তাদের কাজে কেউ-ই সন্তুষ্ট হতে পারছেন না। দেবাশিসবাবুদের অভিযোগ, “ওই ঠিকাদার সংস্থাই এর জন্য দায়ী। ওদের সদিচ্ছার অভাবেই হলের সংস্কারের কাজ কার্যত কিছুই এগোয়নি।” একই কথা বলছে পূর্ত দফতরও। দফতরের এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার শিবশঙ্কর চক্রবর্তী বলেন, “ওই ঠিকাদার সংস্থার কাজে আমি মোটেই খুশি নয়। আমি ওই সংস্থাকে নিয়োগও করিনি। কাজটা আরও তাড়াতাড়ি হতে পারত। কেন হল না, তা ওই সংস্থাই বলতে পারবে।”
এমনিতে শুধু মাত্র সিউড়িতেই কুড়িটিরও বেশি ছোটবড় নাট্য সংস্থা এবং সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী রয়েছে। কিন্তু নির্দিষ্ট মঞ্চের অভাবে তারা বিভিন্ন হলঘর এবং খোলা মঞ্চেই নানা অনুষ্ঠান করছে। তাতে এক দিকে যেমন প্রযোজনার খরচ বেড়ে যাচ্ছে, অন্য দিকে, অনেক ক্ষেত্রেই আয়োজকেরা সেখানে অনুষ্ঠান করে সন্তুষ্ট হতে পারছেন না। গত এক বছর ধরে ‘বীরভূম আনন’ নাট্যসংস্থা বিশিষ্ট নাট্যকার বাদল দরকারের নাটক নিয়ে ‘বাদল উত্সব’ করছে। তাদেরও একই সমস্যায় পড়তে হয়েছে। সিউড়ির ‘নৃত্যাঙ্গন বিদ্যায়তন’-এর কর্ণধার টুলটুল আহমেদ বলেন, “এখন রবীন্দ্র সদন নেই। তার জন্য আমাদের সাম্প্রতিক অনুষ্ঠান ডিআরডিসি হল ভাড়া করে করতে হয়েছে। কিন্তু তার জন্য প্রচুর জন্য টাকা খরচা হয়েছে। কিন্তু টিকিট বিক্রি করে সে পয়সা ওঠেনি। ফলে রবীন্দ্র সদন না খুললে সমস্যা কিন্তু রয়েই যাবে।” এই পরিস্থিতিতে সম্প্রতি জেলার সভাধিপতির কাছে বিভিন্ন নাট্য ও সাংস্কৃতিক সংস্থা দেখা করে একটি আবেদন জানিয়েছে। তাদের দাবি, রবীন্দ্র সদনের সংস্কার না মেলার কারণে জেলা পরিষদের আওতাধীন ডিআরডিসি হলটি যেন সাংস্কৃতিক সংস্থাগুলির জন্য অল্প টাকায় ভাড়া দেওয়া হয়। ওই হলের বর্তমান ভাড়া প্রায় ছ’ হাজার টাকা।
এ প্রসঙ্গে জেলার সভাধিপতি বিকাশ রায়চৌধুরী বলেন, “আমরা নাট্য ও সংস্কৃতিপ্রেমীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। দেখি, এ নিয়ে কী করা যায়।” অন্য দিকে, জেলাশাসক জগদীশপ্রসাদ মিনা বলেন, “আপাতত পূর্ত দফতরের কাছ থেকে ৫০ লক্ষ টাকা নিয়ে ইলেকট্রিক্যাল কাজের জন্য দেওয়া হবে। বাকি টাকার জন্য রাজ্য সরকারের কাছে আবেদন করা হবে। ওই হলের সংস্কার যাতে দ্রুত হয়, তা-ও দেখা হবে।” ঠিকাদার সংস্থার সঙ্গে অবশ্য যোগাযোগ করা যায়নি। |