ভোটের ফল শেষ পর্যন্ত যা-ই হোক, লোকসভায় এ বার সম্ভবত একটি সরব মুখ হারাতে চলেছে বামেরা! দীর্ঘ ২৫ বছরের সংসদীয় ইনিংসে ইতি টানতে চেয়ে আর ভোটে দাঁড়াবেন না বলে দলের কাছে অব্যাহতি চেয়েছেন সিপিআই সাংসদ গুরুদাস দাশগুপ্ত। শেষ মুহূর্তে অন্য কিছু না ঘটলে বামফ্রন্টের প্রার্থী তালিকায় গুরুদাসবাবুর জায়গায় এ বার নতুন মুখ আসারই সম্ভাবনা।
সিপিআইয়ের সংসদীয় দলনেতা গুরুদাসবাবু চলতি লোকসভায় একের পর এক দুর্নীতির ঘটনায় সরব হয়েছেন। টুজি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারি বা কৃষ্ণা-গোদাবরী বেসিন-কাণ্ডে তাঁর প্রতিবাদের জন্যই নানা সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে ইউপিএ সরকারকে। এ হেন ‘সক্রিয়’ সাংসদ শেষ পর্যন্ত বামেদের প্রার্থী তালিকায় না-থাকলে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হবে বলেই বাম শিবিরের ব্যাখ্যা। এখনও পর্যন্ত যা পরিস্থিতি, রাজ্যসভায় সিপিএমের শ্যামল চক্রবর্তীর মতোই লোকসভা থেকে স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়ানোর পথে হাঁটতে চলেছেন সিপিআইয়ের গুরুদাসবাবু।
দিল্লিতে গত দু’দিন দলের জাতীয় কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে পশ্চিমবঙ্গের আসনগুলির প্রার্থী বাছাইয়ের ব্যাপারে চুলচেরা আলোচনা করেছেন সিপিআইয়ের শীর্ষ নেতৃত্ব। সেই বৈঠকেই গুরুদাসবাবু তাঁর সরে দাঁড়ানোর আর্জির কথা জানিয়ে দিয়েছেন বলে সিপিআই সূত্রের খবর। দলের অন্দরে গুরুদাসবাবুর বক্তব্য, তাঁর বয়স এখন ৭৮। আবার ভোটে দাঁড়ালে ও জিতলে পরের বার মেয়াদ শেষের সময়ে বয়স হবে ৮৩! ওই বয়সে প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হলে নানা কথা উঠবে। তার চেয়ে ক্রিকেটার সুনীল গাওস্করের মতো ফর্ম থাকতে থাকতে ছেড়ে দেওয়াই ভাল! দলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সমীকরণ মেনে সিপিআই রাজ্য নেতৃত্বও সম্ভবত বর্ষীয়ান সাংসদের আর্জি মেনে নিতে পারেন। আগামী সপ্তাহেই বৈঠকে বসছে সিপিআইয়ের রাজ্য কার্যনির্বাহী কমিটি। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তাঁরা সম্ভাব্য সব দিক ভেবে নিতে চাইছেন। ঘটনা হল, গুরুদাসবাবুকে নিয়ে কিছু দিন ধরে যথেষ্টই টানাপোড়েন চলেছে সিপিআইয়ের অন্দরে। গুরুদাসবাবুর বর্তমান আসন ঘাটাল এ বার বিশেষ ‘নিরাপদ’ নয় বলে তাঁকে বসিরহাট থেকে প্রার্থী করতে চাইছিল দলের একাংশ। পঞ্চায়েত ভোট ও সাম্প্রতিক অঙ্কের বিচারে বসিরহাট আসনটি বামেদের জন্য তুলনায় ‘ইতিবাচক’। কিন্তু দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতাই ওই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে। তাঁদের যুক্তি, সঙ্কটের সময় গুরুদাসবাবুর মতো ‘হেভিওয়েট’ নেতা অন্য আসনে সরে গেলে ভুল বার্তা যাবে। দলের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য নেতৃত্বের আলোচনায় এই নিয়ে কোনও মীমাংসাসূত্র বেরোয়নি। মেদিনীপুরের সাংসদ প্রবোধ পণ্ডা এক সময় তাঁর আসনটি প্রবীণ সতীর্থকে ছেড়ে দিতেও চেয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত দলের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে নিজেই সরে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন এআইটিইউসি-র সাধারণ সম্পাদক গুরুদাসবাবু।
দলের মধ্যে গোটা প্রক্রিয়া এখনও চূড়ান্ত না হওয়ায় গুরুদাসবাবু অবশ্য বাইরে মুখ খুলছেন না। যোগাযোগ করা হলে তিনি শুধু বলছেন, “দলকে মতামত জানিয়েছি। যা করার দলই ঠিক করবে।” সিপিআইয়ের কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের কথায়, “আমাদের দলের গঠনতন্ত্রে কারও নাম প্রত্যাহার করে নেওয়ার সুযোগ আছে। গুরুদাসবাবু দলকে জানিয়েছেন, সংসদীয় রাজনীতি থেকে সরে দল ও শ্রমিক সংগঠনের কাজেই থাকবেন।” কোথাও জায়গা ফাঁকা হলে অন্য রাজ্য থেকে রাজ্যসভায় যেতে চান না বলেও দলকে জানিয়েছেন ঘাটালের সাংসদ।
মোট ২৫ বছরের সংসদীয় কেরিয়ারে রাজ্যসভায় ১৫ বছর ও লোকসভায় ১০ বছর, দুই কক্ষেই দাপিয়ে গলা ফাটিয়েছেন গুরুদাসবাবু। উপনির্বাচন থেকে রাজ্যসভায় গিয়েছিলেন ১৯৮৫ সালে। পরে ১৯৮৮ এবং ১৯৯৪, আরও দু’বার রাজ্যসভায়। লোকসভায় দাঁড়িয়ে ‘পাঁশকুড়া লাইনে’র সময় উপনির্বাচনে বিক্রম সরকারের কাছে হার। তার পরে ২০০৪-এ পাঁশকুড়া থেকেই এবং ২০০৯-এ সীমানা পুনর্বিন্যাসের পরে ঘাটাল থেকে লোকসভায় নির্বাচিত। সিপিআইয়ের রাজ্য নেতৃত্ব এখন চাইছেন, ঘাটাল এবং বসিরহাট দুই আসন থেকেই এ বার নতুন মুখ দাঁড় করাতে।
বামেদের প্রার্থী তালিকা ঠিক করার কাজ এখন জোর কদমে। সিপিআই এখনও তাদের সিদ্ধান্তের কথা সিপিএমকে জানায়নি। তবে সিপিএম চাইছে, এলাকার রাজনৈতিক সমীকরণের কথা মাথায় রেখে বসিরহাটে দাঁড় করানো হোক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কাউকে। সিপিএমের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার এক নেতার কথায়, “এ বার ওই সব এলাকায় বিজেপি-র কিছু ভোট কাটার কথা। সেখানে সংখ্যালঘু প্রার্থী থাকলে সুবিধাই হবে।” |