প্রবাদে আছে। কিন্তু মাঘের শীতের সঙ্গে বাঘের মিল এ বার অন্তত পাওয়া যাচ্ছিল না। তবে মাসের প্রথমে না-হোক, সেই বাঘা শীতটা আসছে শেষ দিকে। আর এ ভাবেই মাঘের মহিমা অটুট রাখার চেষ্টা করছে উত্তুরে হাওয়া। তাপমাত্রা এতটাই নামছে যে, শৈত্যপ্রবাহের কবলে পড়েছে দক্ষিণবঙ্গের একাংশ। কলকাতায় শৈত্যপ্রবাহ না-হোক, রাতে কনকনে ঠান্ডা মিলবে বলে হাওয়া অফিসের পূর্বাভাস।
এমনটা যে এ বারেই প্রথম ঘটল, তা অবশ্য নয়। এক দশকের মধ্যে এই নিয়ে পরপর তিন বার মাঘের দ্বিতীয়ার্ধে পারদের আকস্মিক পতন-প্রবণতা লক্ষ করা গেল। শীতের এই খামখেয়ালে আবহাওয়া পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেখছেন অনেক পরিবেশবিদই।
আবহাওয়ায় কতটা কী বদল ঘটছে, দেখছে হাওয়া অফিস। আমজনতার নগদপ্রাপ্তি বলতে সরস্বতী পুজোর মুখে এই শীতটুকুই। রবিবার কলকাতায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৩.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস, স্বাভাবিকের থেকে দু’ডিগ্রি কম। আজ, সোমবার মহানগরের তাপমাত্রা আরও কিছুটা কমতে পারে বলে ইঙ্গিত মিলেছে। আবহবিদদের আশ্বাস, কাল, মঙ্গলবার সরস্বতী পুজোয় শীতকে স্বমেজাজেই পাওয়া যাবে। ১০ বছরে ফেব্রুয়ারির গোড়ায় পারদ মাত্র দু’বার ১৪ ডিগ্রির নীচে নেমেছে। ২০০৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা নেমেছিল ১২.৬ ডিগ্রিতে। সেটাই এ-পর্যন্ত সব থেকে কম। |
যেখানে পারদ (২ ফেব্রুয়ারি) |
সাল |
তাপমাত্রা* |
২০০৫ |
১৭.৩ |
২০০৬ |
১৫.১ |
২০০৭ |
১৯.১ |
২০০৮ |
১২.৬ |
২০০৯ |
১৬.৯ |
২০১০ |
১৪.১ |
২০১১ |
১৬.৫ |
২০১২ |
১৩.৪ |
২০১৩ |
১৪.৪ |
২০১৪ |
১৩.৭ |
* সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ডিগ্রি সেলসিয়াসে |
|
পারদের নিম্নগতি এ বার সেই মাত্রা ছুঁয়ে ফেলতে পারে। কারণ, রবিবার বীরভূমে শৈত্যপ্রবাহ বয়েছে (কোনও এলাকায় স্বাভাবিক সর্বনিম্ন তাপমাত্রা থেকে পাঁচ ডিগ্রি কমে গেলে সেই পরিস্থিতিকে শৈত্যপ্রবাহ বলে)। আগামী ৪৮ ঘণ্টায় বীরভূম ছাড়াও পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বর্ধমান (শিল্পাঞ্চল) জেলায় শৈত্যপ্রবাহ হতে পারে। দক্ষিণবঙ্গে শৈত্যপ্রবাহের ঘটনা সাধারণত ঘটে পৌষে বা মাঘের প্রথম দিকে। যদিও চলতি মরসুমে তেমনটা ঘটেনি। জানুয়ারিতে শুধু বীরভূমেই মাত্র এক দিন শৈত্যপ্রবাহ বয়েছে। ফের সে হাজির মাঘের শেষ পর্বে।
শীতের এই খেয়ালিপনা কেন?
হাওয়া অফিস সূত্রের খবর, বায়ুমণ্ডলের উপরের স্তরে বায়ুপ্রবাহের কিছুটা অদলবদল ঘটায় চলতি মরসুমে কয়েকটি পশ্চিমী ঝঞ্ঝা বাংলার দিকে এসেছিল। তৈরি করেছিল উচ্চচাপ। তাতে বাধা পায় উত্তুরে হাওয়া। মাঝেমধ্যেই উচ্চচাপের দোসর হয়ে শীতের সামনে পাঁচিল তুলেছিল মধ্য ভারত কিংবা বাংলাদেশের ঘূর্ণাবর্ত। আবহবিজ্ঞানীরা বলছেন, টানা কয়েক দিন সেই পশ্চিমী ঝঞ্ঝা নেই বলেই দক্ষিণবঙ্গে শীত থিতু হচ্ছে। আলিপুর আবহাওয়া দফতরের প্রধান গোকুলচন্দ্র দেবনাথ বলছেন, “উচ্চচাপের বাধা না-থাকায় উত্তর ভারত থেকে কনকনে ঠান্ডা হাওয়া বয়ে আসছে।”
অর্থাৎ উচ্চচাপ বা ঘূর্ণাবর্ত একেবারে সামনে থেকে উত্তুরে হাওয়ার সঙ্গে লড়লেও এ বার শীত-ঘাটতির মূলে খলনায়ক সেই পশ্চিমী ঝঞ্ঝা। আবহবিজ্ঞানের পরিভাষায় পশ্চিমী ঝঞ্ঝা হল ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা থেকে বয়ে আসা বায়ুপ্রবাহ। আবহবিদদের ব্যাখ্যা, গত তিন বছরে ওই ঝঞ্ঝার চরিত্র অনেক বদলে গিয়েছে। আবহাওয়ার পরিবর্তন হচ্ছে জম্মু-কাশ্মীর, হিমাচল-সহ গোটা উত্তর ভারতে। সেখানে শীতের কামড় জোরদার হচ্ছে। দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে শীতের আয়ু। তার প্রভাবে শেষ বেলায় বাংলাতেও দ্বিতীয় ইনিংসে শীতের ব্যাটে টি-টোয়েন্টির মেজাজ।
দক্ষিণবঙ্গে শীত সাধারণত দু’টি ইনিংস খেলে। ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত প্রথম ইনিংস। আর দ্বিতীয় ইনিংস জানুয়ারির চতুর্থ সপ্তাহ থেকে ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত। প্রথম ইনিংসটা যেন জোয়ার। তখন তাপমাত্রা ক্রমশ নামতে থাকে। আর দ্বিতীয় ইনিংসটা যেন ভাটা। তখন পারদ আর খুব একটা নামে না। দিনের তাপমাত্রা ক্রমশ বাড়তে থাকায় শীত-শীত ভাব অনেকটাই চলে যায়। কখনও কখনও অবশ্য এই নিয়মের পরিবর্তন ঘটে। সেটাকে আবহবিদেরা বলেন অস্বাভাবিক ঘটনা। দক্ষিণবঙ্গে অস্বাভাবিক সেই ঘটনাটাই এখন স্বাভাবিক হতে যাচ্ছে কি না, তা নিয়ে শুরু হয়েছে জল্পনা।
উত্তরবঙ্গের পরিস্থিতি অবশ্য দক্ষিণবঙ্গের থেকে অনেকটাই আলাদা। সেখানে এখন ঘন কুয়াশায় চার দিক ঢাকা পড়ে গিয়েছে। দিনের বেলা তাপমাত্রা স্বাভাবিকের নীচে নেমে যাচ্ছে। রাতের তাপমাত্রা অবশ্য সে-ভাবে কমছে না। আবহবিজ্ঞানের পরিভাষায় এই পরিস্থিতিকে বলা হয় ‘শীতল দিন’।
শেষ বেলায় দক্ষিণবঙ্গে শীতের দাক্ষিণ্য কত দিন পাওয়া যাবে?
দিল্লির মৌসম ভবন সূত্রের খবর, ৫ ফেব্রুয়ারি নাগাদ ফের একটি পশ্চিমী ঝঞ্ঝা কাশ্মীর ও হিমাচলে আছড়ে পড়তে পারে। সেটি কোন দিকে বইবে, তার উপরেই বাংলায় শীতের দ্বিতীয় ইনিংস নির্ভর করছে। তার দাপটে কোনও উচ্চচাপ বলয় বা ঘূর্ণাবর্তের সৃষ্টি হলে ফের শীতের দফারফা হয়ে যেতে পারে। আর কোনও বাধার প্রাচীর না-তুলে ঝঞ্ঝা যদি অন্য দিকে বয়ে যায়, শেষ মাঘে কয়েক দিন শীত পেতে পারে বাংলা। |