নন্দীগ্রামের ভুল আগেই স্বীকার করেছিলেন। এ বার নেতাই-কাণ্ডেও প্রকাশ্যে দোষ কবুল করলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তবে একই সঙ্গে তৃণমূলকে বিঁধে বললেন, “আমরা ভুল হলে স্বীকার করি। ওরা (তৃণমূল) স্বীকার করে না। অন্যায়কে টেনে নিয়ে চলে!”
লালগড়ের নেতাই গ্রামে ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি সিপিএম কর্মী রথীন দণ্ডপাটের বাড়ি থেকে নির্বিচারে ছোড়া গুলিতে মারা গিয়েছিলেন চার মহিলা-সহ ৯ জন গ্রামবাসী। আহত হন অন্তত ২৮ জন। অভিযোগ ওঠে, মাওবাদীদের সন্ত্রাস রোখার নাম করে ওই বাড়িতে সশস্ত্র শিবির বসিয়েছিল সিপিএমের লোকেরা। গ্রামের লোকেদের খাবারদাবার দিতে বাধ্য করার পাশাপাশি অস্ত্র প্রশিক্ষণও দিত তারা। এর প্রতিবাদ করাতেই গ্রামবাসীদের উপরে গুলি ছোড়া হয়।
|
মেদিনীপুরের জনসভায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। পাশে সিপিএমের
জেলা সম্পাদক দীপক সরকার। রবিবার। —নিজস্ব চিত্র। |
ঘটনার তদন্তে নেমে একে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলে উল্লেখ করে সিবিআই। কিন্তু সেই মন্তব্য এবং রাজ্য জুড়ে প্রবল বিরূপ প্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও ভুল স্বীকার করতে রাজি হননি সিপিএমের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা নেতৃত্ব। তাঁরা দোষারোপ করেছিলেন মাওবাদী চক্রান্তকে। মূলত জেলা নেতৃত্বের চাপেই বিধানসভায় হারের পরে সিপিএম কেন্দ্রীয় কমিটির পর্যালোচনা রিপোর্টে ঠাঁই পায়নি নেতাই প্রসঙ্গ। এমনকী, ২০১২-র রাজ্য সম্মেলনের দলিলে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম-সহ একগুচ্ছ ভুলের কথা থাকলেও উল্লেখ করা হয়নি নেতাই-কাণ্ড।
অবশেষে রবিবার মেদিনীপুরে ব্রিগেড সভার প্রচার উপলক্ষে বামফ্রন্টের সমাবেশে বুদ্ধবাবু বললেন, “নেতাইয়ে আমাদের ছেলেরা ভুল করেছিল। অন্যায় করেছিল!” আর নন্দীগ্রাম সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য, “অনেকে বলেন, নন্দীগ্রামের ঘটনা নিয়ে তো আপনি দুঃখপ্রকাশ করেছেন। হ্যাঁ করেছি। মানুষ মারা গেলে কি হাসব? নিরীহ মানুষ মারা গেলে দুঃখপ্রকাশ করতেই হয়। ভুল হয়েছে বলতেই হয়!”
রাজ্য সরকারের দাবি সত্ত্বেও নন্দীগ্রাম কাণ্ডে বুদ্ধবাবুর কোনও ভূমিকা ছিল না বলে আগেই রিপোর্ট দিয়েছে সিবিআই। সম্প্রতি তারা আরও বলেছে, নন্দীগ্রামে আন্দোলনকারীদের দিক থেকে গুলি আসার ফলেই আত্মরক্ষায় পাল্টা গুলি চালাতে বাধ্য হয়েছে পুলিশ। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার এই দুই পর্যবেক্ষণ রাজনৈতিক ভাবে খানিকটা সুবিধা করে দিয়েছে সিপিএমের। এই পরিস্থিতিতে নেতাই নিয়ে ভুল স্বীকার করে বুদ্ধবাবু লোকসভা ভোটের আগে সহানুভূতি কুড়োচ্ছেন বলেই মত তৃণমূলের। |
মেদিনীপুরে জনসভায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। |
এ দিন বুদ্ধবাবুর মন্তব্যকে কটাক্ষ করে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন বুদ্ধবাবুকে বলতাম ভুলের মন্ত্রী! একের পর এক হত্যালীলা করেছেন, আর পরে আস্তিন গুটিয়ে ক্ষমা চেয়েছেন! এ সব নাটুকেপনা ছাড়া অন্য কিছু নয়! ভোটের মুখে এখন সহানুভূতি পেতে এ সব কথা বলছেন!” বর্ধমান কাঞ্চন উৎসবের উদ্বোধনে গিয়ে এ দিন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ও বলেছেন, “ওরা বারবার ক্ষমা চায় আর বলে ভুল হয়েছে! কিন্তু বাংলা জুড়ে ওরা যত খুন, সন্ত্রাস চালিয়েছে, তাতে বাংলার মানুষ তাদের ক্ষমা করবেন না!”
নেতাই মামলায় ২০ জন সিপিএম নেতা-কর্মীর নামে চার্জশিট দেওয়া হয়েছিল। তার মধ্যে ১২ জন গ্রেফতার হয়েছেন। ফেরারদের মধ্যে আছেন সিপিএমের তৎকালীন বিনপুর (লালগড়) জোনাল কমিটির সম্পাদক অনুজ পাণ্ডে, ধরমপুর লোকাল সম্পাদক ডালিম পাণ্ডে, বেলাটিকরি লোকাল সম্পাদক চণ্ডী করণ, লালগড় লোকাল কমিটির সম্পাদক জয়দেব গিরি। রয়েছেন খলিলউদ্দিন, তপন দে, জেলা পরিষদের প্রাক্তন সদস্য ফুল্লরা মণ্ডল, রথীন দণ্ডপাটের নাম। মার্চে মামলার বিচার-পর্ব শুরু হওয়ার কথা।
আর এই ফেরারদের প্রসঙ্গ তুলেই তৃণমূল সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীর কটাক্ষ, “উনি (বুদ্ধবাবু) যদি সত্যিই অনুতপ্ত হন, তা হলে অনুজ পাণ্ডে, ডালিম পাণ্ডেদের পদ থেকে সরানোর ব্যবস্থা করেননি কেন? কেন ওই অভিযুক্তদের আত্মসমর্পণ করাননি?”
বুদ্ধবাবুর মন্তব্যে বিড়ম্বনায় সিপিএমের পশ্চিম মেদিনীপুর নেতৃত্বও। সেই অস্বস্তি সামাল দিতে এ দিনের সমাবেশের পরে দলের জেলা সম্পাদক তথা রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য দীপক সরকার বলেনন, “তৃণমূল আর মাওবাদী মিলেই তো পরিবেশটা তৈরি করেছিল! ওই দিন সশস্ত্র মাওবাদীরা জমায়েত না-করলে নেতাইয়ের ঘটনা ঘটত না।” |
সিপিএমের কেশপুরের নেতাকর্মীরা রবিবার মিছিল করে মেদিনীপুর শহরে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জনসভায়
যোগ দিতে আসেন। মিছিলে নেতৃত্ব দেন সিপিএম নেতা তরুণ রায়, এন্তাজ আলি প্রমুখ (বাঁ দিকে)। এ দিন
সকালে শালবনির পিঁড়াকাটায়
বুদ্ধবাবুর মেদিনীপুর সফরের বিরোধিতায় ধিক্কার মিছিল করে তৃণমূল। মিছিল
থেকে ‘গো- ব্যাক’ স্লোগানও তোলা হয়।
মিছিলে ছিলেন শালবনির বিধায়ক শ্রীকান্ত মাহাতো, জেলা
পরিষদ সদস্য
সনৎ মাহাতো (ডান দিকে)। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল ও রামপ্রসাদ সাউ। |
তৃণমূল-মাওবাদী আঁতাঁতের অভিযোগ অবশ্য এ দিন বুদ্ধবাবুও করেছেন। তাঁর কথায়, “তৃণমূল তখন মাওবাদীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল। আমরা বুঝেছিলাম, বিপদ আসছে। তৃণমূলের সঙ্গে হাত মেলানোর পর ওরা মেদিনীপুর শহরের কাছাকাছি চলে আসে। শেষ পর্যন্ত মাওবাদী-তৃণমূলের আক্রমণের কাছে আমরা হেরে গেলাম।”
নন্দীগ্রাম নিয়ে সিবিআই রিপোর্টকে যে সিপিএম আসন্ন লোকসভা ভোটে অস্ত্র করবে, তা-ও নিজের বক্তৃতায় বুঝিয়ে দিয়েছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। সেখানেও তৃণমূল মাওবাদীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে বলে বিধানসভা ভোটের আগেই অভিযোগ করেছিলেন তিনি। এ দিন তার পুনরাবৃত্তি করে বুদ্ধবাবু বলেন, “আমি ওখানে গিয়ে মিটিং করে বলেছিলাম, জমি নেব না। তার পরেও তৃণমূল-মাওবাদী মিলে মাসের পর মাস গণ্ডগোল করল। তার পরে পুলিশ পাঠাই। পুলিশ কেন গিয়েছিল? জমি নিতে, না আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করতে? আজ সিবিআই রিপোর্টে সব পরিষ্কার হচ্ছে!”
একদা লালদুর্গ পশ্চিম মেদিনীপুরে বিধানসভা ভোটের পর থেকেই সিপিএম কার্যত কোণঠাসা। পরিস্থিতি এমনই যে ইদানীং কালে গোটা জেলাতেই বামেরা কোনও বড় সভা করেনি। পঞ্চায়েত ও পুরভোটের প্রচারেও আসেননি বড় কোনও নেতা। বুদ্ধবাবু নিজে শেষ বার সভা করতে এসেছিলেন ২০১২-র ১ ফেব্রুয়ারি দলের জেলা সম্মেলন উপলক্ষে।
এ দিনের সমাবেশ বানচাল করতে শাসক তৃণমূল ভয় দেখিয়েছে বলেও অভিযোগ তুলেছেন সিপিএম নেতারা। তবে তার পরেও যা ভিড় হয়েছে, তাতে তাঁরা উল্লসিত।
ঘটনাচক্রে, এ দিনই দক্ষিণ ২৪ পরগনার ডায়মন্ড হারবার ও যাদবপুরে ব্রিগেডের প্রস্তুতি সমাবেশে তৃণমূল নেত্রীর ব্রিগেড-বক্তব্যকে বিঁধে সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য সীতারাম ইয়েচুরি বলেছেন, “ইউপিএ সরকার দুর্নীতিগ্রস্ত। সেই সরকারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী ছিলেন। আর ‘দাঙ্গার সরকার’ মানে এনডিএ-র আমলেও তিনিই রেলমন্ত্রী ছিলেন!” ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক দলগুলির সঙ্গে সমঝোতার লক্ষ্যে ৫ তারিখ সংসদে তাদের সঙ্গে বৈঠক হবে বলে জানিয়েছেন ইয়েচুরি। |