ঘুম থেকে উঠে সাতসকালে স্নান। শীতে কাঁপতে কাঁপতে অঞ্জলি দেওয়ার তাড়া। তারপর বেলা বাড়তেই উধাও ঠান্ডার চোখরাঙানি। এক স্কুল থেকে আর এক স্কুলে ঘুরতে ঘুরতে কপালে জমতে থাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম। বাড়তে থাকে অনভ্যস্ত শাড়ির অস্বস্তিও। ফি বছর এ ভাবেই বাঙালির ভ্যালেন্টাইন ডে-তে যেন ঘাম দিয়ে শীত ছাড়ে!
কিন্তু সরস্বতী পুজোর এই চেনা ছবিটা এ বার কিন্তু উধাও। সন্ধ্যার পর থেকেই কনকনে উত্তুরে হাওয়ার দাপটে সুনসান হয়ে যাচ্ছে পথঘাট। দোকানপাট বন্ধ করে ঘরে ফিরতে পারলেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচছেন ব্যবসায়ীরা। দিনের বেলা রোদ উঠলে অবশ্য ততটা শীত লাগছে না। কিন্তু সকালে এবং সন্ধ্যার পর জাঁকিয়ে পড়ছে ঠান্ডা। সব থেকে মারাত্মক ভোরের কুয়াশা। প্রতিদিনই কুয়াশার কারণে বিঘ্নিত হচ্ছে যান চলাচল, খেয়া পারাপার। আবহাওয়া দফতরের খবর, গোটা ফেব্রুয়ারি জুড়েই লম্বা ইনিংস খেলবে এ বারের শীত। জেন ওয়াইয়ের অনেকেরই আশঙ্কা, এ বারের সরস্বতী পুজো টুপি, সোয়েটার, জ্যাকেটে ঢেকে যাবে না তো?
সাধারণ মানুষ অবশ্য হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন এ বারের শীত-কুয়াশার যুগলবন্দি। মাঝ-মাঘের সন্ধ্যার কুয়াশা ভোরে যেন আরও জমাট বাঁধছে। সেই কুয়াশা কাটতে কাটতে সকাল দশটা। প্রায় বাইশ বছর ধরে গঙ্গা পেরিয়ে ট্রেনে কৃষ্ণনগর-শিয়ালদহ যাতায়াত করছেন নবদ্বীপের বিশ্বরূপ মুখোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, “শীতের এমন অদ্ভুত চরিত্র এর আগে কখনও দেখিনি। ক’দিন দিব্যি একটা হাফ সোয়েটার আর মাফলারেই কাজ চলে যাচ্ছে। ক’দিন বাদে আবার জ্যাকেট, হনুমান টুপি, দস্তানা, চাদর চড়িয়েও হু হু করে কাঁপতে হচ্ছে। কিছুতেই শীত ভাঙছে না।” |
কুয়াশাকে সমঝে চলছেন বাসকর্মীরাও। ঘন কুয়াশার কারণে সকালের দিকে অনেক রুটেই নির্ধারিত সময়ে বাস চলছে না। নদিয়ার বাস মালিক সমিতির তরফে অসীম সাহা বলেন, “এ বারের কুয়াশা সত্যিই মনে রাখার মতো। গত তিন-চার দিন ধরে সকাল সাতটা সাড়ে সাতটার আগে বাস চালানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে। দূরপাল্লার বাস চালানোর ঝুঁকি অনেকেই নিতে চাইছেন না। আবার যে বাসগুলো চলছে তাতে যাত্রীও থাকছে না।” খেয়া পারাপারের অবস্থাও তথৈবচ। নবদ্বীপ, মায়াপুর, স্বরূপগঞ্জের মতো ঘাটগুলোতে সকাল দশটার আগে খেয়া ছাড়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে সময়ের হিসাব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন পর্যটক থেকে নিত্যযাত্রী সকলেই। একই কারণে ট্রেন চলাচলও সময়মতো না হওয়ায় অনেক নিত্যযাত্রী ঠিক সময়ে অফিসে পৌঁছতে আগের ট্রেন ধরছেন।
তবে শীত-কুয়াশার এই ভোগান্তিতেও স্বস্তি মিলছে বাজার দরে। এ বারের সরস্বতী পুজোতে কিন্তু সদয় হয়েছেন লক্ষ্মী। খিচুড়ি, পাঁচ তরকারি, আলুর দম, চাটনি ও পায়েস-- ঠাকুরের ভোগের এই ‘পঞ্চরত্নের’ জোগাড় করতে গিয়ে মোটেই মুখ ভার হওয়ার কথা নয় আমবাঙালির। শীতকালীন শাক-সব্জি থেকে রান্নার গ্যাস, মুদিখানার চিনি, তেল থেকে চাল-ডাল নতুন করে কোনও কিছুরই আর দাম বাড়েনি। চাষীরা জানাচ্ছেন, এমন শীত কিছু দিন থাকলে সব্জির দাম আরও কমবে। তবে কুয়াশার কারণে ফুলের দাম কিছুটা চড়া। কুড়িটা ফুল দিয়ে গাঁথা গাঁদার মালা বিকোচ্ছে আট থেকে দশ টাকায়।
বৈষ্ণবশাস্ত্র মতে, সরস্বতী পুজো তথা শ্রীপঞ্চমীর দিন থেকেই ঋতু বসন্তের সূচনা। মন্দিরে মন্দিরে এ দিন থেকে কীর্তনের সুরে লাগে বসন্ত রাগের ছোঁয়া। পুজোর উপকরণে থাকে আবির, কুমকুমের অনিবার্য উপস্থিতি। বলা হয় সরস্বতী পুজো আসলে বসন্তোৎসবের সূচনা। যা সমাপ্ত হয় দোল পূর্ণিমায়। কিন্তু গাঢ় কুয়াশা আর উত্তুরে হাওয়ার সৌজন্যে কনকনে ঠান্ডায় বাঙালির ভ্যালেন্টাইন কি আদৌ জমবে? কলেজ পড়ুয়া নীপবীথী দত্ত, সুদেষ্ণা ভট্টার্চায, পায়েল করেরা অবশ্য হাসতে হাসতে বলছেন, “জমতেই হবে। শীত কমুক নাই বা কমুক আজ শ্রীপঞ্চমী।” |